হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বহুল আলোচিত ভুল উদ্ধৃতি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ এবং অস্টিন রবিনসনের সেই ১২৫ বছর তত্ত্বের দেশ, কিভাবে, কেন, কোন ফর্মুলায় প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, এক দুর্ভিক্ষ, তিন সফল ও ৩০ টি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং চারটি ভয়াবহ বন্যা ঠেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনেছে এবং চোখ ধাঁধানো অর্থনীতিক উন্নয়নের খেলা দেখাচ্ছে তা তাদের বোধগম্য হয় না।
কোন কোন অর্থনীতিবিদেরা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন উল্লেখ করেন যেখানে গ্রিস, সাইপ্রাস, স্পেন ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, বাংলাদেশ সেখানে কখনও ব্যর্থ হয়না। খরা, বন্যা, সাইক্লোন নিয়েও এদেশের মানুষ সুখী মানুষের হাসি দেয়, সাদা ভাত আর শাক দিয়ে দুইবেলে খেয়েও সুখী মানুষের ইনডেক্সে উপরের দিকে থাকে। এই অর্থনীতিক উন্নয়ন টেকসই কিনা তা নিয়ে আগের দশকে আলাপ উঠত কিন্তু বিগত বছর গুলোতে সে আলাপ আর উঠে না কারণ মজবুত তকমা না পেলেও টেকসই তকমা বাংলাদেশ নিশ্চিত করেছে।
১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ধর্মীয় পার্থক্যের জন্য ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়েছিল আর ১৯৭১ সালে ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্যের জন্য পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছিল। গত বিশ বছরে বাংলাদেশ এই দুই দেশকে অনেকগুলো মাপকাঠিতে পিছে ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতির ও সমাজবিজ্ঞানের বিগ বয়রা (big boys)এখন ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানকে আকারে ইঙ্গিতে পরামর্শ দেন বাংলাদেশের নীতি অনুসরণ করতে।
কিন্তু এর কারণ কি হতে পারে? ওয়াট ডিড বাংলাদেশ ডু রাইট?
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, যার এ দেশের প্রতি আবেগ ও পিছুটান আছে, মনে করেন নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও শিক্ষা খাতে উন্নতি বাংলাদেশের অর্থনীতিক উন্নয়নের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। আর বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে ব্রাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের নারী শিক্ষা ও সমাজে মেয়েদের ভূমিকা জোরালো করা সংক্রান্ত উদ্যোগগুলো ফল দিতে শুরু করেছে যার বাতাস অর্থনীতির অগ্রগতিতে এসে লেগেছে।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ও দ্য ইকোনমিস্টের গবেষক ও প্রবন্ধ লেখকদের মতে বাংলাদেশের শ্রম আইন আসেপাশের দেশগুলো থেকে অনেক বেশী ডেভেলপমেন্ট ফ্রেন্ডলি। যেখানে এখনো বিশ্বের অনেক দেশে কারখানা মালিকদের নানান বিধিনিষেধ মানতে হয়, বাংলাদেশে সেইসব বিধিনিষেধের অনুপস্থিতি গার্মেন্টস শিল্প স্থাপনে সহায়ক হয়েছে। গার্মেন্টস রপ্তানীতে বাংলাদেশ এখন প্রথম সারির প্লেয়ার। এতে অর্থনীতির অগ্রগতি তরান্বিত হয়েছে।
তবে এমন অর্থনীতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও কেন এদেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে নৌকায় করে ইউরোপে পৌছতে চায়, কেন আইনরক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ী মাঝরাতে দরোজার বাইরে দেখলে আঁতকে উঠে, কেন রাষ্ট্রের উপর থেকে নীচে জবাবদিহিতার অভাব বোধ করে, কেন বা নিজ গরজে দেশের রাজধানীকে বিশ্বের প্রথমসারির বিষাক্ত শহর করে ফেলেছে এবং কেনই বা ধর্মীয় উগ্রবাদিতার দিকে প্রবল গতিতে এগোচ্ছে, তা নিয়ে অর্থনীতির ও সমাজবিজ্ঞানের বিগ বয়'রা কথা বলেন কিনা জানি না, তবে বাংলাদেশের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানও বোধকরি 'বাংলাদেশ প্যারাডক্স' নামক আপার্তবৈপরীতাকে ঐসব বৈঠকখানায় জ্বালানী সরবরাহ করে।
আবার চার্ট, গ্রাফ, ইনডেক্সে খুঁজে পাওয়া অগ্রগতি দেশের মানুষ সামষ্টিক ভাবে পাচ্ছে না কেন এবং দুধের উপরের সর ১% মানুষ খেয়ে নিচ্ছে কেন সেও বোধহয় এক প্যারাডক্স।
Comments