সেদিন আকাশ ছিল পরিষ্কার। ফাল্গুনের দুপুর, শীতও নয়, গরমও
নয়। রেসকোর্স ময়দান তৈরী হয়েছিল এক জনসভার জন্য তবে সেটা ছিল না কোন প্রথাগত জনসভা, সেদিন বক্তা মাত্র একজন – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান
শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে;
ভাষণের
নির্ধারিত সময় বেলা দুইটা; রেসকোর্স ময়দান জনসমুদ্র। জনতার ভিড়
ঠেলে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর দেরী হয়; সফেদ পাজামা, পাঞ্জাবি আর
হাতকাটা কালো কোট পরে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে মঞ্চে দাঁড়ীয়ে তিনি উচ্চারন করেন 'ভাইয়েরা আমার...’
এর আগে ১ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের; সারা দেশের
মানুষ রেডিও আর টেলিভিশন খুলে বসে কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিলেন না। একসময়
রেডিওতে ঘোষণা করা হলো – ‘পরবর্তী ঘোষণা
না আসা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছেন। ’
পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভা ছিল ৩ মার্চ; বঙ্গবন্ধু সেখানে আবেগজড়িত কণ্ঠে
বলেছেন - আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার
স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে-
আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন।'
৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার এবং
৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা আভাস দেয় ৭ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা আসতে
পারে; ৬ মার্চ লন্ডনের
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয় –
‘শেখ
মুজিবুর রহমান আগামীকাল পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।'
পাকিস্তান প্রশাসন ও সামরিক চক্র বুঝে নেয় ৭ মার্চ হয়তো চূড়ান্ত
ফাটলের ঘোষণা আসতে পারে কারন বাংলার মাটিতে শেখ মুজিবের কথাই আইন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া
খান টেলিফোন করেন শেখ মুজিবকে, দীর্ঘ আলাপে
বঙ্গবন্ধুকে বলার চেষ্টা করেন - ‘তিনি যেন এমন
কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ রাতে ইয়াহিয়া খান একটি বার্তাও প্রেরণ
করেন যেখানে তিনি শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন - 'অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি সহসাই ঢাকা আসছি এবং
আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আপনাকে প্রতিশ্রতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাক্ষা এবং জনগণের প্রতি
দেয়া আপনার প্রতিশ্রতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে- যা
আপনাকে আপনার ছয়দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।” পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে
বার্তা প্রেরণ করা হয় ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে – ‘৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়।’ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দীর্ঘ
বৈঠক হয় এদিন; একপক্ষ বলে
বঙ্গবন্ধু যেন ৭ মার্চের জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; অন্যপক্ষ সরাসরি ঘোষণা না করে আলোচনার
পথ খোলা রাখতে অনুরোধ করে; তুমুল তর্ক হয়
বৈঠকে।
পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চ সকালে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ডেকে
নিয়ে বলেন -'জনসভায় পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে
কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে
মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে
না।'
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে
বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে
রওনা হলেন তখন ভর দুপুর।
মঞ্চ থেকে ততক্ষণে স্লোগান উঠছে ‘আমার দেশ তোমার
দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘পরিষদ না
রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি
অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো', ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। গাড়ী
চালাচ্ছিলেন ব্যক্তিগত সহযোগী গোলাম মোরশেদ; বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন সাত মসজিদ দিয়ে যেতে, গাড়ীটি সাত মসজিদ রোড দিয়ে জিগাতলা হয়ে রেসকোর্সের
দিকে এগিয়ে এগিয়ে যায়। গাড়ী যখন জিগাতলার কাছে তখন গোলাম মোরশেদ জিজ্ঞেস করেন - ‘আজ কী বলবেন বঙ্গবন্ধু?’ উত্তরে
বঙ্গবন্ধু বলেন - ‘আল্লাহ আমাকে
দিয়ে যা বলাবেন, তাই বলব।’
রওনা হবার আগে আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর হাতে ভাষণের খসড়া তুলে
দিয়েছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্টেজে উঠেন হাতে কোন কাগজ ছাড়া; ভাষণ দেন মন থেকে শব্দমালা তুলে; বলেন - 'আমরা তাদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারব।' পরের নয় মাস তাই
করা হয়েছে; পাকিস্তানের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে
বাংলার অনিয়মিত বাহিনী ভাতে মেরেছে,
পানিতে
মেরেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন - 'সাত কোটি
মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।'
কেউ
পারিনি দাবায় রাখতে। স্বাধীনতা,
মুক্তি
দুইটিই অর্জন করেছে এ দেশের মানুষ। চূড়ান্ত নির্দেশ এসেছে ভাষণের শেষ অংশে - 'প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের
নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন
দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো।
এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।' বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার স্বাধীনতা চাননি, বাঙালির মুক্তিও চেয়েছেন আর ভাষণ শেষ করেছেন এই বলে - ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
জয় বাংলা।
তথ্য সুত্রঃ
১
Comments