ঝকঝকে সকাল।
সিপাহী মুন্সি আব্দুর রউফ টিনের একটা মগে রঙ চা নিয়ে বসে আছে ক্যাম্পের ঠিক বাইরে। যুদ্ধের এই সময় চা খুব একটা পাওয়া যায় না। সকালের রোদে বসে চা খাওয়া মোটামুটি বিলাসিতা। স্থানীয় এক লোক গতকাল বিকালে চা পাতা দিয়ে গেছে তাই আজকের এই আয়েশ। আটারুটি ভিজিয়ে দুধ চা খাওয়া মুন্সি আব্দুর রউফের খুব পছন্দ। অনেকদিন হলো তা খাওয়া হয় না। আজ রঙ চা পাওয়া গেছে, কম কি।
চায়ে চুমুক দিয়ে লেকের দিকে তাকায় রউফ। স্বচ্ছ, শান্ত, শীতল সবুজ পানি। লেকের মাঝে একটা বাঁশের মাথায় বসে আছে একটা পাখি। পানকৌড়ি নাকি? ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে রউফের চাকরীর বয়স আট বছর। দেখতে দেখতে কেটে গেল! রেজিম্যান্টেড জীবন, শান্তও না, শীতলও না। গতমাস থেকে তো উত্তাল।
আটটায় ডিউটি শুরু হবে। সে নানিয়ারচর উপজেলাধীন বাকছড়ি ক্যাম্পের অধীনে আছে। খবর আছে পাকিস্তান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে এ দিকে। আজ কালকের মধ্যেই তারা রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথ অতিক্রম করতে চাইবে।
রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথ স্ট্রাটেজিক দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারন এ পথ পাকিস্তান আর্মি কোন ভাবে অতিক্রম করতে পারলে মানিকছড়ি, মহালছড়ি আর রামগড় আয়ত্তে নিতে পারবে। তাই সেক্টর কমান্ডার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর এর ১৫০ জন সৈনিককে দায়িত্ব দিয়েছেন এখানে নিরাপত্তাব্যুহ তৈরি করতে এবং পাকিস্তান আর্মির চলাচল প্রতিরোধের। মুন্সি আব্দুর রউফ এই ক্যাম্পের এক নম্বর এলএমজি ম্যান।
এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে তারা এসেছে এখানে। সৈনিক আছে ১৫০ জন কিন্তু অস্ত্র ও গোলাবারুদ খুবই অপ্রতুল। ভারতীয়দের সহযোগিতার নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি।
চা শেষ করে ইউনিফর্ম পরে নেয় রউফ। যুদ্ধের কারনে ইউনিফর্মের ব্যাপারে অফিসাররা অনেক শিথিল। তবে মূলটা ঠিক রাখতে হয়।
আটটা বাজবার একটু আগেই রউফ উপস্থিত হয় ট্রেঞ্চে। ট্রেঞ্চটি মূল ভূখণ্ড থেকে একটু বাইরে, একটা টিলার উপর। এখান থেকে লেকের অনেকটা দেখা যায়। সেপাহী মুতাব্বর তাকে দেখে বলে - আসি গেছোনি গেঁরাই?
রউফ মুতাব্বরের কাছ থেকে বুঝে নেয় লাইট মেশিন গান ও গুলি। ট্রেঞ্চে ঢুকে মেশিনগানের গায়ে গাল ঠেকিয়ে পরীক্ষা করে নেয় এঙ্গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আছে আজ কালকের মধ্যে পাকিস্তান আর্মির দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান অতিক্রম করবে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথ। কিন্তু এই খবর নেই যে পাকিস্তান আর্মি জেনে গেছে বাকছড়ির এই জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তান আর্মির কাছে এও খবর আছে যে ১৫০ জনের উপর সৈনিক থাকলেও ক্যাম্পে নেই তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র বা গোলাবারুদ।
পাকিস্তান আর্মির দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান বেশ তৈরী হয়েই, দুইটি ষ্টীমার ও সাতটি স্পিডবোটের বিশাল বহর নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপস্থিত হয় নানিয়ারচরে। সাথে আছে কয়েকটি তিন ইঞ্চি মর্টার ও বেশ কিছু দূরপাল্লার ভারী মেশিনগান। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান মোটামুটি চিহ্নিত তাদের কাছে।
রউফ ট্রেঞ্চে বসে দুর থেকে শত্রুর বিশাল বহর দেখেই বুঝে ফেলে কঠিন পরিস্থিতিতে পরতে যাচ্ছে তারা। সে চিৎকার করে ক্যাম্পের অন্যদের জানিয়ে দেয় পাকিস্তান আর্মি এগিয়ে আসছে। তারপর লাইট মেশিনগানের গায়ে কাঁধ ঠেকায়।
এগিয়ে আসছে বহরের সামনের স্পিডবোটটি। ঠিক তার পাশেই আর একটি। তার পেছনে আরও চারটি কি পাঁচটি। তার পেছনে দুটি লঞ্চ।
ক্যাম্পে সব রাইফেল, শুধু একটিই মেশিন গান। সেটা রউফের কাছে। ট্রেঞ্চে জায়গা একজনের। গুলি ভরে তাকে কেউ সাহাজ্য করবে এমন উপায়ও নেই। গুলিও আছে সীমিত। রউফ স্থির করে এলোপাথারি গুলি সে করবে না।
সামনের দুটি স্পিডবোট মুটামুটি একই সময়ে রউফের লাইট মেশিন গানের রেঞ্জের ভেতরে ঢুকে। সে গুলি করে। অব্যর্থ নিশানা। স্পিডবোটে থাকা দুইজন পাকিস্তানি কমান্ডো ও চালক হতাহত হয়। বাকীরা ঝাপিয়ে পরে পানিতে। রউফ এবার দ্বিতীয় স্পিডবোটের উপর নিশানা ঠিক করে। সেটা এর মধ্যে বাম দিকে সরে আরেকটু এগিয়ে এসেছে। রউফ এবারও অব্যর্থ নিশানায় থামিয়ে দেয় তার গতি। গুলি খেয়ে তিন চারজন পাকিস্তানি কমান্ডো পানিতে পরে যায়। বাকীরা গুলি চালাতে শুরু করে ক্যাম্প বরাবর। লক্ষভ্রষ্ট গুলি।
স্পিডবোটটি থেমে আছে। রউফ এবার গুলি করে আরও কয়েকজন পাকিস্তানীকে ঘায়েল করে। খুব বেশী গুলি তার খরচ করতে হয় না।
ক্যাম্পের বাকি মুক্তিযোদ্ধারাও গুলি করতে থাকে পাড় থেকে।
পাকিস্তানি কমান্ডোরা পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নেয়। একদল পানিতে ঝাপিয়ে পরে এগিয়ে আসতে থাকে পাড়ের দিকে আর অন্যরা স্পিডবোট থেকেই গুলি করতে থাকে। সাথে শুরু করে ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ। গোলাগুলো এসে ক্যাম্পের আসেপাশে পরতে থাকে।
গোলাগুলির শব্দ ভাঙামুড়া গ্রামে এসে পৌঁছায়। গ্রামটি ক্যাম্পের কাছেই। মাঝে একটা ছোট নদী। গ্রামের মুরব্বীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। গ্রামের ৮০টি পরিবারের মধ্যে দুইটি বাদে বাকী সব রওনা হয়ে যায়। দয়াল কৃষ্ণ চাকমা বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে থেকে যায়। বৃদ্ধ বাবা-মা হাটবার অবস্থায় নেই।
স্পিডবোট গুলো এবং লঞ্চ দুটি মর্টার থেকে গোলা এবং দূরপাল্লার ভারী মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসে। রউফ এবার গুলি করে আরও একটি স্পিডবোট ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু লঞ্চ থেকে ছোড়া গোলা এবং গুলির তোপে পাড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে। এই ফাকে কিছু পাকিস্তানি কমান্ডো পাড়ে উঠে পরে। রউফ দ্রুত লেক থেকে দৃষ্টি পাড়ে আনে। নিশানা স্থির করে কয়েকজন পাকিস্তানি কমান্ডোকে ঘায়েল করে সে।
বাকছড়ি ক্যাম্প কম্যান্ডার বুঝে ফেলেছেন একটা লাইট মেশিন গান আর কিছু রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানীদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। রিইনফোর্সমেন্টও আসবে না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন অবস্থান ছেড়ে দেবার। নির্দেশ দেন ক্যাম্পের সবাইকে গ্রামের দিকে চলে যেতে।
মুতাব্বর ক্রল করে আসে ট্রেঞ্চের দিকে। কিছু গুলির বাক্স ছুঁড়ে দেয় ট্রেঞ্চের ভেতর। ক্যাম্প কম্যান্ডারের নির্দেশ জানিয়ে দেয় রউফকে - আমরা ফিচু হইটতেসি গেঁড়াই, আপনে কভার দিতি থাকেন। রউফ এক ঝটকায় সম্মতি জানিয়ে আবার লাইট মেশিন গানে কাঁধ রাখে। অগ্রসমান পাকিস্তানী সেনা ও ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেই একমাত্র প্রাচীর এখন। অন্তত কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে হবে পাকিস্তানী কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান। নাহলে মারা যাবে সবাই।
ক্যাম্পের সবাই পিছু হটতে থাকে। শুধু ট্রেঞ্চে থেকে যায় সেপাহী রউফ। তিনটি স্পিডবোট ডুবিয়ে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে।কিন্তু সে বুঝে তার সময় বেশী নেই, পাকিস্তানীরা এক সময় চিহ্নিত করে ফেলবে তার অবস্থান। সে এবার একটি লঞ্চের দিকে ব্যারেল তাক করে। বেশ কিছু গুলি ছুঁড়ে। পর মুহূর্তে দেখে কিছু পাকিস্তানী সেনা টুপটুপ করে পরে গেল পানিতে। কিন্তু লঞ্চ ডুবানো যায় না। সে অনবরত গুলি করতে থাকে। একসময় লঞ্চ একদিকে কাত হয়ে যায়।
এর মধ্যে তিনটি স্পিডবোটে করে বেশ কিছু পাকিস্তানী সেনা পাড়ের দিকে এগিয়ে আসা শুরু করেছে। পাড় থেকে তো শুধু সেই গুলি করছে। এবার সে একটু এলোপাথারি গুলি শুরু করে। ডুবিয়ে দেয় স্পিডবোট তিনটি। যেসব পাকিস্তানী সৈন্য পানিতে ঝাপ দেয়, তাদেরকেও হতাহত করে।
কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত।
একটু নিস্তব্ধ হয়ে উঠে এলাকা। কোন গুলাগুলি নেই।
পাকিস্তানি কমান্ডোরা এবার একটু পিছনে হটে যেয়ে লাইট মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে অবস্থান নেয়। এখন সেপাহী রউফ গুলি করলেও পৌঁছাবে না লক্ষে। রউফ থেমে থেমে গুলি করে যদিও তার কাছে এখনও পর্যাপ্ত গুলি রয়েছে। পাকিস্তানি কমান্ডোরা রেঞ্জের বাইরে থেকে এবার ধীরে সুস্থে ট্রেঞ্চের অবস্থান নির্ণয় করার প্রয়াস পায়।
রউফের পিপাসা মারাত্মক আকার ধারন করেছে। সে দ্রুত ওয়াটার বটোল বের করে কয়েক চুমুক পানি খায়। এই তার শেষ পানি খাওয়া। আবার মেশিনগানে কাঁধ ঠেকায় সে, পাকিস্তানীদের গতি প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করে। কত সময় গেছে? ক্যাম্পের সবাই কি নিরাপদ অবস্থানে যেতে পেরেছে?
একসময় পাকিস্তানি কমান্ডোরা রউফের অবস্থান নির্ণয় করে মর্টার থেকে গোলা ছোড়া শুরু করে। একটা গোলা ঠিক ট্রেঞ্চের পাশেই এসে পরে। পাকিস্তানীরা তার মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে জেনেও এলোপাথারি গুলি করতে শুরু করে রউফ। প্রতিটি গুলি লেইকের পানিতে যেয়ে আলোড়ন তোলে, লঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছায় না।এইসময় হেলমেটের ফাক দিয়ে এক খণ্ড ঘাম কপাল বেয়ে গালে এসে পৌঁছায়। রউফের ইচ্ছে হয় ঘামটি চেটে নেবার। কিন্তু ফুসরত হয় না। মর্টারের একটা গোলা এসে পরে ট্রেঞ্চের ভেতর। মুহূর্তেই ছিটকে যায় মেশিন গানের ব্যারেল। রউফের বাম পা দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়, হেলমেটের কারনে মাথাটি আস্ত থাকলেও এক চোখের উপর কাল দাগ লেপটে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয় সিপাহী রউফের।
ততক্ষণে বাকীসব মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে ভাঙামুড়া গ্রামে পৌঁছে গেছে। গ্রামের ৮০টি পরিবারের মধ্যে দুইটি বাদে বাকী সব এরমধ্যেই মহালছড়ির দিকে পালিয়ে গেছে। দয়াল কৃষ্ণ চাকমা বুড়িঘাট ক্যাম্প কম্যান্ডারকে বলে - স্যার আমি আপনাদেরকে এগিয়ে দিতে পারবো। ক্যাম্প কম্যান্ডার তাকে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত নেন। বলেন দ্রুত তৈরী হয়ে নিতে। সে তৈরী হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নামেহুং গ্রাম পর্যন্ত এগিয়ে দেয় এবং বলে একটু এগিয়ে গেলে তারা নোয়াদাম পৌঁছাবে। সেখানে যেন তারা গৌতম মণি চাকমা ও মরাচেঙ্গের গোবিন্দ মহাজনের খোঁজ করে।
গ্রামে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় দয়াল কৃষ্ণ চাকমার। সব চুপচাপ। দয়াল কৃষ্ণ চাকমা ঠিক করে রাতে আর নদী পার হবেনা।
পরদিন সকালে দয়াল কৃষ্ণ ভাই জ্যোতিষ চন্দ্রকে নিয়ে বাকছড়ি ক্যাম্পে যায়। ঘুরে দেখে সারা এলাকা। সামনে এগিয়ে দেখে টিলা মতন জায়গাতে এক মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ পড়ে আছে। ক্যাম্পে সে মাঝে মধ্যে এসেছে আগে কিন্তু সেপাহী মুন্সি আব্দুর রউফের সাথে পরিচয় হয়নি কখনো। দয়াল কৃষ্ণ ও জ্যোতিষ চন্দ্র রউফের দেহ সেই টিলাকেই মাটিচাপা দেয় বেনামী কবর হিসাবে।
-x-
পরিশিষ্টঃ সেই কবর বেনামী হয়ে সেখানেই থেকে যায় এর পরের ২৬ বছর। রাষ্ট্র সেপাহী মুন্সি আব্দুর রউফকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী দিয়ে মর্যাদা দিয়েছে কিন্তু তিনি কোথায় ঘুমিয়ে আছেন তা নির্ণয় করেনি। ১৯৯৬ সালে এসে রাষ্ট্র সেই বেনামী কবরকে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের কবর বলে শনাক্ত করে। দয়াল কৃষ্ণ ও জ্যোতিষ চন্দ্র তখনো বেঁচে ছিলেন।
Comments