আমার বড় খালু এয়ার কমোডর চৌধুরী সি এ মান্নানের সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অসম বন্ধুত্ব।
রক্ষণশীল পরিবারের ভেতর এবং আদব কায়দা লেহাজ মেনে চলা এক পরিমণ্ডলে, গুরুগম্ভীর এবং সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে ভার্সিটি পড়ুয়া ভাগনার বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া বেশ অস্বাভাবিক।
কিন্তু পরিবারের সবার চোখ এড়িয়ে আমাদের দুইজনের বন্ধুত্ব হয়েছিল।
যাদের সাথে আলাপচারিতায় জ্ঞ্যানের পরিধি বাড়ে, আমি তাদের কাছে ছুটে যেতাম কিট-পতঙ্গ যেমন ছুটে যায় আলোর দিকে। বড় খালু ছিলেন তেমন এক আলো।
আমার বইয়ের 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' নামক গল্পে বড় খালুর ছায়া আছে। গল্পের ন্যারেটর যে শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছে, যার কাছ থেকে ন্যারেটর দিকনির্দেশনা নিতে অভ্যস্ত, সেই শিক্ষকের ক্যারেক্টারটিতে আমার বড় খালুর ছায়া রয়েছে। এবং 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' গল্পের কিছুটা খালুর সাথে বিভিন্ন সময় হওয়া আলাপচারিতার মাঝ থেকে উঠে এসেছে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খালু থাকতেন উত্তরায়। আমি মাঝে মাঝে চলে যেতাম তার বাসায়। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে বই আনতাম, পড়তাম এবং ফেরত দেবার সময় সেই বই নিয়ে তার সাথে কথা বলতাম।
২০০১ এর নির্বাচনের সময় আমি প্রথমবার ভোটার। শিহরিত।
নির্বাচনের দুইদিন আমি খালুর কাছে গেলাম দিকনির্দেশনা নেওয়ার জন্য। তাকে প্রশ্ন করলাম - কাকে ভোট দেব?
তিনি বললেন - তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে কাকে ভোট দেবে; তবে আমি ভোট দেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে, আমি ভোট দেবো সেই দলকে যে দল এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে এয়ারফোর্সে উচ্চপদে চাকরী করা মানুষটির এমন বক্তব্যে ধাক্কা খেয়েছিলাম।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুছে দেবার আপ্রান রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার ভুক্তভুগী আমিও। তাই আমার কিছু কথায় তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন - ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতর একজন জেনারেল, কিছু ব্রিগেডিয়ার এবং কিছু কর্নেলের হাতে গড়া একটি দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে? যে দল গঠিত হয়েছিল একটা ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা হিসেবে, সেই দল এই দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিবে আবার?
আমি চমকে উঠেছিলাম।
তাকে প্রশ্ন করেছিলাম আওয়ামী লীগ তো ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তাহলে কেন নৌকায় ভোট দেবো? তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক দোষ আছে, আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার অনেক কিছু শেখার আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মদদ পুষ্ট স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি এবং জামাতকে ক্ষমতায় বসাতে ভোট দিতে হবে।
তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে, না হলে এই দেশ সামনে আগাবে না। পিছাবে।
২০০১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়, পাকিস্তানের আই এস আইের জিত হয়, 'জাতীয়তাবাদ' ফিরে আসে। দেশ আবার পিছাতে থাকে। আমি রাজাকারের গাড়ীতে পতাকা দেখে মন খারাপ করে যাই খালুর কাছে। খালু বলেন, আওয়ামী লীগের দোষ ছিল তাই হেরেছে কিন্তু শুধুমাত্র এক স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে যে দলের সৃষ্টি, ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যে দলের সৃষ্টি, জাতীর পিতাকে মুছে ফেলার নীতি যে দলের মূল রাজনৈতিক আদর্শ, সেই দল টিকবে না।
আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছি,পাল্টা যুক্তি দিয়েছি। তিনি তার অবস্থানে অনড় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন হাসিনা, শেখের বেটি; ও একদিন ওর বাবার হত্যাকারীদের বিচার করবে। আমার বিশ্বাস হয়নি খালুর কথা।
প্রশাসনে জামায়াত-শিবিরের গন নিয়োগ, ২০০৪ এর ২১শে আগস্টের রাষ্ট্রীয় মদদে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে শাহ্ কিবরিয়াকে হত্যা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হোসেনের উপর গ্রেনেড হামলা, রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলা ভাইয়ের উত্থান, ছাত্র শিবিরের তাণ্ডব, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যাপক ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা, বাশখালীতে ১৩ জন হিন্দুকে পুড়িয়ে মারা ইঙ্গিত দিচ্ছিল বিএনপি-জামাত টিকে যাবে এবং এ দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে 'বাংলাস্থান' করেই ছাড়বে। ২০০৬ এ দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল হাওয়া ভবন ও তারেক রহমান দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল।
২০১৮ তে এসে দেখি আমি ভুল ছিলাম। খালু ঠিক ছিলেন তার বিশ্লেষণে।
যে শিক্ষকের ক্যারেক্টারটি আমি এঁকেছি 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' গল্পে, সেই ক্যারেক্টারটি স্বাভাবিকভাবেই একক কোন চরিত্র থেকে আসেনি। আমার জীবনে যাদের প্রভাব আছে তাদের অনেকের ছায়া আছে সেখানে। মেট্রোপলিটন শহরের ডামাডোলে আর চাকরী জীবনের নানা সমীকরনের জটিলতায় তাদের অনেককের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। সে কথাও উঠে এসেছে গল্পে।
সংবাদপত্রে পড়া কিছু প্রবন্ধের বিষয়বস্তুও উঠে এসেছে গল্পে।
গল্পে লিখেছি - তিন বন্ধুর এক বন্ধু রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের প্রথম লগ্নে জাতীয়পার্টি করে দ্বিতীয় লগ্নে বিএনপিতে এসে স্থির হলেন। লিখেছি অগ্নিসংযোগ আর জমি দখলের ঘটনা দিয়ে তার পোর্টফলিও পরিপূর্ণ। লিখেছি বিএনপিতে থাকাকালীন সময়ে হিন্দু মেরে 'সোয়াব' কামিয়েছেন অনেক।
জাতীয়পার্টি আর বিএনপির রাজনীতিবিদদের বেসিক চরিত্র এমনই দেখেছি আমি বারে বারে। যখন যে ভাত ছিটিয়েছে, তখন সেখানেই জুড়েছে তারা।
বিএনপিতে বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন, পদকধারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তারা কি করে এমন এক দলে থাকেন যে দলের মূল পুঁজি হিন্দু তথা ভারত বিদ্বেষ? তারা কেমন করে পাকিস্তানী জেনারেলদের বানানো নামতা 'আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দেবে' জপে জপে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে রাজনীতি করেন? তারা কি এর মধ্যে পক্ষ পরিবর্তন করে ফেলেছেন? তারা কি অনুতপ্ত যে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছেন? আমার জীবনে যাদের প্রভাব আছে, যাদেরকে এমন প্রশ্ন করা যায়, করেছি গত ১০ বছরে। কেউ কেউ ফর্মুলা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে, কেউ কেউ আমাকে বলেছেন ১৯৭১ সালের বীর দেশপ্রেমিক কে কখন পাকিস্তানের আই এস আইয়ের বেতনভুক্ত হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। একজন বলেছেন রাজাকার কোনদিন দেশপ্রেমিক হয় না, কোন কোন দেশপ্রেমিক একসময় রাজাকার হয়।
হয়তো তারা পক্ষ পরিবর্তন করেছেন, হয়তো তাদের পরবর্তীতে মনে হয়েছে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে ভুল করেছেন। না হলে ইনিয়ে বিনিয়ে ১৫ আগস্ট কীভাবে তারা সমর্থন করেন? না হলে জামাতের শীর্ষনেতাদের সাথে বসতে কেন তারা সাচ্ছন্দ বোধ করেন? যে দল শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানায়, যে দল গোলাম আজমকে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত করে, সেই দলে 'মুক্তিযোদ্ধা' থাকে কি করে? যাই তারা হউন, দেশপ্রেমিক আর নন তারা। এবং এরকম একটি দল যে ধ্বজভঙ্গ হবে, মাজা ভাঙ্গা হবে, তথাকথিত আপোষহীন নেত্রীকে জেলে রেখে সোশ্যাল এলিট কামাল হোসেনের গড়া জোটে ঢুকে নির্বাচন করবে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিপক্কতার কাছে নত হয়ে শিশু রুপে কোলে শুয়ে বোতলে দুধ খাবে, তাতে হয়তো অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আমার অবাক লাগে। আরও অবাক লাগে যে বড় খালু ধরতে পেরেছিলেন যে ষড়যন্ত্রের ফসল যে দল, সেই দল ডুববে কিন্তু ২০০৬ সালে সেই দলের দুর্বার গতিতে ছুটে চলা দেখতে দেখতে বড় খালু মারা গেছেন। আমাকে রেখে গেছেন তার ভবিষ্যৎবানী ফলে কিনা তা দেখতে।
অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের যে পথে দেশকে শেখ হাসিনা পরিচালিত করছেন গত সাত আট বছর সেটা দেখছি ঠিকই কিন্তু ব্যপক দুর্নীতি, চরম অপশাসনও দেখছি। দেখছি সমাজের ক্ষয়। দেখেছি ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। এসব কি কাম্য আওয়ামী লীগের কাছে? আওয়ামী লীগ কি পারে দায় এড়াতে?
আমার ইচ্ছে হয় 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' এর আদলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে যেখানে একটি ছেলে অথবা মেয়ে হঠাৎ করে সুযোগ পাবে শেখ হাসিনার সাথে কিছু সময় কাটাতে এবং সে ভীরু ভীরু কণ্ঠে শেখ হাসিনাকে বিব্রত করবার মতো প্রশ্ন করবে। তাদের আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে যাবে।
২০১৮ তে দাঁড়িয়ে আমি যখন পেছনে ফিরি তখন আমার ভাল লাগে। দেশটা পাকিস্তানের পথে হাঁটছে না দেখে ভাল লাগে। হাওয়া ভবন হাওয়া হয়েছে দেখে ভাল লাগে। সৎ বাবার চোর ছেলের সঠিক সাজা হয়েছে দেখে ভাল লাগে। শেখ হাসিনা তার বাবার হত্যাকারীদের বিচার করেছেন দেখে ভাল লাগে। শেখ হাসিনা ১৯৭১ এর যুদ্ধঅপরাধীদের বিচার করেছেন দেখে ভাল লাগে।
২০১৮ তে দাঁড়িয়ে আমি আশাবাদী হই কারন এইদেশ এখন সামনে এগুচ্ছে। আশাবাদী হই কারন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষদের মাথা তুলে বেঁচে থাকবার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। আশাবাদী হই কারন এই বাংলাদেশকে আমার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী লাগে।
আমার এই ভাললাগা, আমার এই আশাবাদও উঠে আসবে আগামীর এক গল্পে।
- বাতাস পরিবর্তনের গল্প ও অন্যান্য
- বইয়ের প্রচ্ছদ
রক্ষণশীল পরিবারের ভেতর এবং আদব কায়দা লেহাজ মেনে চলা এক পরিমণ্ডলে, গুরুগম্ভীর এবং সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে ভার্সিটি পড়ুয়া ভাগনার বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়া বেশ অস্বাভাবিক।
কিন্তু পরিবারের সবার চোখ এড়িয়ে আমাদের দুইজনের বন্ধুত্ব হয়েছিল।
যাদের সাথে আলাপচারিতায় জ্ঞ্যানের পরিধি বাড়ে, আমি তাদের কাছে ছুটে যেতাম কিট-পতঙ্গ যেমন ছুটে যায় আলোর দিকে। বড় খালু ছিলেন তেমন এক আলো।
আমার বইয়ের 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' নামক গল্পে বড় খালুর ছায়া আছে। গল্পের ন্যারেটর যে শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছে, যার কাছ থেকে ন্যারেটর দিকনির্দেশনা নিতে অভ্যস্ত, সেই শিক্ষকের ক্যারেক্টারটিতে আমার বড় খালুর ছায়া রয়েছে। এবং 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' গল্পের কিছুটা খালুর সাথে বিভিন্ন সময় হওয়া আলাপচারিতার মাঝ থেকে উঠে এসেছে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খালু থাকতেন উত্তরায়। আমি মাঝে মাঝে চলে যেতাম তার বাসায়। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে বই আনতাম, পড়তাম এবং ফেরত দেবার সময় সেই বই নিয়ে তার সাথে কথা বলতাম।
২০০১ এর নির্বাচনের সময় আমি প্রথমবার ভোটার। শিহরিত।
নির্বাচনের দুইদিন আমি খালুর কাছে গেলাম দিকনির্দেশনা নেওয়ার জন্য। তাকে প্রশ্ন করলাম - কাকে ভোট দেব?
তিনি বললেন - তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে কাকে ভোট দেবে; তবে আমি ভোট দেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে, আমি ভোট দেবো সেই দলকে যে দল এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে এয়ারফোর্সে উচ্চপদে চাকরী করা মানুষটির এমন বক্তব্যে ধাক্কা খেয়েছিলাম।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুছে দেবার আপ্রান রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার ভুক্তভুগী আমিও। তাই আমার কিছু কথায় তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন - ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতর একজন জেনারেল, কিছু ব্রিগেডিয়ার এবং কিছু কর্নেলের হাতে গড়া একটি দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে? যে দল গঠিত হয়েছিল একটা ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা হিসেবে, সেই দল এই দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিবে আবার?
আমি চমকে উঠেছিলাম।
তাকে প্রশ্ন করেছিলাম আওয়ামী লীগ তো ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তাহলে কেন নৌকায় ভোট দেবো? তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক দোষ আছে, আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার অনেক কিছু শেখার আছে, কিন্তু তার মানে এই না যে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মদদ পুষ্ট স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি এবং জামাতকে ক্ষমতায় বসাতে ভোট দিতে হবে।
তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে, না হলে এই দেশ সামনে আগাবে না। পিছাবে।
২০০১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়, পাকিস্তানের আই এস আইের জিত হয়, 'জাতীয়তাবাদ' ফিরে আসে। দেশ আবার পিছাতে থাকে। আমি রাজাকারের গাড়ীতে পতাকা দেখে মন খারাপ করে যাই খালুর কাছে। খালু বলেন, আওয়ামী লীগের দোষ ছিল তাই হেরেছে কিন্তু শুধুমাত্র এক স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে যে দলের সৃষ্টি, ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যে দলের সৃষ্টি, জাতীর পিতাকে মুছে ফেলার নীতি যে দলের মূল রাজনৈতিক আদর্শ, সেই দল টিকবে না।
আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছি,পাল্টা যুক্তি দিয়েছি। তিনি তার অবস্থানে অনড় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন হাসিনা, শেখের বেটি; ও একদিন ওর বাবার হত্যাকারীদের বিচার করবে। আমার বিশ্বাস হয়নি খালুর কথা।
প্রশাসনে জামায়াত-শিবিরের গন নিয়োগ, ২০০৪ এর ২১শে আগস্টের রাষ্ট্রীয় মদদে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে শাহ্ কিবরিয়াকে হত্যা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হোসেনের উপর গ্রেনেড হামলা, রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলা ভাইয়ের উত্থান, ছাত্র শিবিরের তাণ্ডব, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যাপক ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা, বাশখালীতে ১৩ জন হিন্দুকে পুড়িয়ে মারা ইঙ্গিত দিচ্ছিল বিএনপি-জামাত টিকে যাবে এবং এ দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে 'বাংলাস্থান' করেই ছাড়বে। ২০০৬ এ দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল হাওয়া ভবন ও তারেক রহমান দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল।
২০১৮ তে এসে দেখি আমি ভুল ছিলাম। খালু ঠিক ছিলেন তার বিশ্লেষণে।
যে শিক্ষকের ক্যারেক্টারটি আমি এঁকেছি 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' গল্পে, সেই ক্যারেক্টারটি স্বাভাবিকভাবেই একক কোন চরিত্র থেকে আসেনি। আমার জীবনে যাদের প্রভাব আছে তাদের অনেকের ছায়া আছে সেখানে। মেট্রোপলিটন শহরের ডামাডোলে আর চাকরী জীবনের নানা সমীকরনের জটিলতায় তাদের অনেককের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। সে কথাও উঠে এসেছে গল্পে।
সংবাদপত্রে পড়া কিছু প্রবন্ধের বিষয়বস্তুও উঠে এসেছে গল্পে।
গল্পে লিখেছি - তিন বন্ধুর এক বন্ধু রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের প্রথম লগ্নে জাতীয়পার্টি করে দ্বিতীয় লগ্নে বিএনপিতে এসে স্থির হলেন। লিখেছি অগ্নিসংযোগ আর জমি দখলের ঘটনা দিয়ে তার পোর্টফলিও পরিপূর্ণ। লিখেছি বিএনপিতে থাকাকালীন সময়ে হিন্দু মেরে 'সোয়াব' কামিয়েছেন অনেক।
জাতীয়পার্টি আর বিএনপির রাজনীতিবিদদের বেসিক চরিত্র এমনই দেখেছি আমি বারে বারে। যখন যে ভাত ছিটিয়েছে, তখন সেখানেই জুড়েছে তারা।
বিএনপিতে বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন, পদকধারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তারা কি করে এমন এক দলে থাকেন যে দলের মূল পুঁজি হিন্দু তথা ভারত বিদ্বেষ? তারা কেমন করে পাকিস্তানী জেনারেলদের বানানো নামতা 'আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দেবে' জপে জপে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে রাজনীতি করেন? তারা কি এর মধ্যে পক্ষ পরিবর্তন করে ফেলেছেন? তারা কি অনুতপ্ত যে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছেন? আমার জীবনে যাদের প্রভাব আছে, যাদেরকে এমন প্রশ্ন করা যায়, করেছি গত ১০ বছরে। কেউ কেউ ফর্মুলা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে, কেউ কেউ আমাকে বলেছেন ১৯৭১ সালের বীর দেশপ্রেমিক কে কখন পাকিস্তানের আই এস আইয়ের বেতনভুক্ত হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। একজন বলেছেন রাজাকার কোনদিন দেশপ্রেমিক হয় না, কোন কোন দেশপ্রেমিক একসময় রাজাকার হয়।
হয়তো তারা পক্ষ পরিবর্তন করেছেন, হয়তো তাদের পরবর্তীতে মনে হয়েছে পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে ভুল করেছেন। না হলে ইনিয়ে বিনিয়ে ১৫ আগস্ট কীভাবে তারা সমর্থন করেন? না হলে জামাতের শীর্ষনেতাদের সাথে বসতে কেন তারা সাচ্ছন্দ বোধ করেন? যে দল শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানায়, যে দল গোলাম আজমকে পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত করে, সেই দলে 'মুক্তিযোদ্ধা' থাকে কি করে? যাই তারা হউন, দেশপ্রেমিক আর নন তারা। এবং এরকম একটি দল যে ধ্বজভঙ্গ হবে, মাজা ভাঙ্গা হবে, তথাকথিত আপোষহীন নেত্রীকে জেলে রেখে সোশ্যাল এলিট কামাল হোসেনের গড়া জোটে ঢুকে নির্বাচন করবে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিপক্কতার কাছে নত হয়ে শিশু রুপে কোলে শুয়ে বোতলে দুধ খাবে, তাতে হয়তো অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আমার অবাক লাগে। আরও অবাক লাগে যে বড় খালু ধরতে পেরেছিলেন যে ষড়যন্ত্রের ফসল যে দল, সেই দল ডুববে কিন্তু ২০০৬ সালে সেই দলের দুর্বার গতিতে ছুটে চলা দেখতে দেখতে বড় খালু মারা গেছেন। আমাকে রেখে গেছেন তার ভবিষ্যৎবানী ফলে কিনা তা দেখতে।
অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের যে পথে দেশকে শেখ হাসিনা পরিচালিত করছেন গত সাত আট বছর সেটা দেখছি ঠিকই কিন্তু ব্যপক দুর্নীতি, চরম অপশাসনও দেখছি। দেখছি সমাজের ক্ষয়। দেখেছি ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। এসব কি কাম্য আওয়ামী লীগের কাছে? আওয়ামী লীগ কি পারে দায় এড়াতে?
আমার ইচ্ছে হয় 'তিন বন্ধু ও শেখ মুজিব' এর আদলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে যেখানে একটি ছেলে অথবা মেয়ে হঠাৎ করে সুযোগ পাবে শেখ হাসিনার সাথে কিছু সময় কাটাতে এবং সে ভীরু ভীরু কণ্ঠে শেখ হাসিনাকে বিব্রত করবার মতো প্রশ্ন করবে। তাদের আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে যাবে।
২০১৮ তে দাঁড়িয়ে আমি যখন পেছনে ফিরি তখন আমার ভাল লাগে। দেশটা পাকিস্তানের পথে হাঁটছে না দেখে ভাল লাগে। হাওয়া ভবন হাওয়া হয়েছে দেখে ভাল লাগে। সৎ বাবার চোর ছেলের সঠিক সাজা হয়েছে দেখে ভাল লাগে। শেখ হাসিনা তার বাবার হত্যাকারীদের বিচার করেছেন দেখে ভাল লাগে। শেখ হাসিনা ১৯৭১ এর যুদ্ধঅপরাধীদের বিচার করেছেন দেখে ভাল লাগে।
২০১৮ তে দাঁড়িয়ে আমি আশাবাদী হই কারন এইদেশ এখন সামনে এগুচ্ছে। আশাবাদী হই কারন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষদের মাথা তুলে বেঁচে থাকবার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। আশাবাদী হই কারন এই বাংলাদেশকে আমার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী লাগে।
আমার এই ভাললাগা, আমার এই আশাবাদও উঠে আসবে আগামীর এক গল্পে।
- বাতাস পরিবর্তনের গল্প ও অন্যান্য
- বইয়ের প্রচ্ছদ
Comments