১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ইতিহাসে, লেখালিখিতে, তর্ক -বিতর্কে প্রবল প্রতাপে বিচরন করে। ১৯৮১ সালের জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডও একরকম তাই। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ফারুক-রশিদ-ডালিম গংয়ের ক্যু করার প্রচেষ্টা এবং ১৯৭৭ সালের বিমানবাহিনীর সৈনিকদের করা বিদ্রোহ নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা, লেখালিখি হয় না। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ বড় ছেলে, ১৯৮১ সেজ ছেলে এবং ১৯৯০ ছোট ছেলে। মেঝ ছেলে ১৯৭৭ মুখচোরা, কোথাও তার উচ্চবাচ্য নেই। তাই অবাক হয়েছি যখন দেখলাম দেশের অন্যতম প্রধান চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সেই ইতিহাসের একটা অংশ নিয়ে আনিসুল হকের আয়েশামঙ্গল উপন্যাস অবলম্বনে একটা টেলিফিল্ম তৈরি করেছেন এবং তা দর্শকদের মাঝে প্রচণ্ড অগ্রহ তৈরি করেছে।
১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ও সাপ্লাই কোরের সৈনিকরা এবং বিমানবাহিনীর সৈনিকরা যে বিদ্রোহ করে, তাতে তারা বিদ্রোহের প্রথম প্রহরেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১১ জন অফিসার ও এক অফিসারের ১৬ বছরের ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। নিশ্চিত ভাবেই সে প্রহরে ফিরে এসেছিল '৭৫ এর ৭ নভেম্বরের রক্তনেশা - অফিসারের রক্ত চাই, সৈনিক-সৈনিক ভাই ভাই। কিন্তু সরকার ( জিয়াউর রহমান তখন দেশের সর্বময় কর্তা এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ) সমর্থিত সেনাদল দ্রুত তেজগাঁও বিমানবন্দর দখল নেয়, রেডিও স্টেশন দখল নেয়, বিদ্রোহের মূল হোতাদের গ্রেফতার করে। দ্বিতীয় প্রহরেই স্তিমিত হয়ে যায় দেশের দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লব।
দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লবের পরের ইতিহাস করুণ। জিয়াউর রহমান-মীর শওকত-মঞ্জুর গংয়ের নির্দেশে জাসদের ও বামপন্থীদের বীজ সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে উপড়ে ফেলার চেস্টা হিসেবে অতিস্বল্প সময়ের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় কয়েকশো, মতান্তরে কয়েক হাজার বিমানসেনাদের যাদের বেশীরভাগেরই কোন পন্থার সাথে পরিচয় ছিল না, ছিলো না কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ । তাদের দোষ যা ছিল তা হলো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ( কুর্মিটোলা বেইস ও তেজগাঁও বিমানবন্দর ) উপস্থিত থাকা । আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন রকম সুযোগ পায়নি এসব অভিযুক্তরা। কোন কোন বিচার কাজ শেষ হয়েছে ১০ মিনিটের মধ্যে, রায় - ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াড। লাশ দেয়া হয়নি পরিবারের কাছে; একই গর্তে হিন্দু, মুসলিম একাধিক লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে; কোন রেকর্ড রাখা হয়নি, কবরের ফলক তো দূরের কথা।
ফায়ারিং স্কোয়াডের পাল্লায় পরা এক বিমানসেনা ও তার স্ত্রীর স্ট্রাগেল নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিফিল্ম আয়শা। আমাদের ফিল্মমেকাররা আসলে শিখে গেছেন যা বলতে পারা যায় না, সেটা কীভাবে বলে ফেলা যায়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী চমৎকার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এ ব্যাপারে। আয়শা টেলিফিল্মে তিনি বলে ফেলেছেন অনেককিছু। তবে টেলিফিল্মটি আরও এনগেজিং হতো যদি বিমানবাহিনীর প্রচলিত জারগন ব্যবহার করা হতো, চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রটিকে আর একটু ফুটিয়ে তুললে এবং ন্যারেটিভে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরলে।
১৯৭৭ সালের ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত না এমন দর্শকদের কাছে টেলিফিল্মটি একরকম আবেদন নিয়ে এসেছে আর যারা সেইসময়ের ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত তাদের কাছে ভিন্ন আবেদন নিয়ে এসেছে। চঞ্চল চৌধুরী শাস্তি পাওয়া বিমানসেনার চরিত্রে সাবলীল নন এবং তার স্ক্রিন উপস্থিতি তুলনামূলক ভাবে কম। রিফাত চৌধুরী দুলাভাই চরিত্রে দারুন অভিনয় করেছেন আর দারুন করেছেন প্রবীণ সৈনিকের চরিত্রদানকারী অভিনেতা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ ফুটিয়ে তোলার জন্য যা প্রয়োজন, তার সবটাই করেছেন। সীমাব্ধতা ছিল নিশ্চয়ই, তিনি সেগুলো অতিক্রম করে যা বলতে চেয়েছেন, যা দেখাতে চেয়েছেন, পেরেছেন। তিশা শাস্তি পাওয়া বিমানসেনার স্ত্রীর চরিত্রে অনবদ্য। স্বামীকে সামরিক কর্তৃপক্ষ মেরে ফেলেছে জেনে অন্তসত্তা তিশা দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে যখন প্রশ্ন করেছেন - বুকে গুলি করসেন না মাথায়, স্যার?, আমি কেঁদে ফেলেছি। আর এক জায়গায় তিনি বলেন -আমি তো জানি না আমার স্বামীকে কোথায় কবর দিয়েছে তাই আমি যেখানেই মোনাজাত ধরব, আল্লাহ কবুল করে নেবেন। আমি জানি না তিশা বা ফারুকী ১৯৭৭ সালের হারিয়ে যাওয়া সৈনিকদের আপনজনদের সাথে দেখা করেছিলেন কিনা প্রিপারেশন হিসাবে। হয়তো করেছেন। বিমানবাহিনীর সেইসব হতভাগ্য সৈনিকদের আপনজনেরা এখনো দেশের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁচে আছেন যারা জানেন না, তাদের বাবা, তাদের স্বামী, তাদের সন্তানদের কবর কোথায় বা আদো কবর দেয়া হয়েছিল কিনা।
'বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস' নামে এক বই বের হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, বা যাদের কাছে আছে তারা স্বীকার করেন না যে আছে তাদের কাছে। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সেই বইয়ের প্রায় সব কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ৫৬১ জন সৈনিককে ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয় । ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ৪০০ থেকে ৫০০ সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সেই একই সময়ে তৎকালীন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন যে বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন বিমান সদস্যের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড ও ২৪৭ জনকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি প্রদান করেছিল মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনাল। লন্ডন টাইমস ১৯৭৮ সালে রিপোর্ট করে যে ঐ ঘটনায় প্রায় ৬০০ জনকে ফাঁসির মাধ্যমে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। আর অভিযুক্ত কয়েকজনের ভাষ্যমতে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী দুই মাসে এক হাজার চারশো সৈনিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মারা হয়। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার লিগ্যাসি অব ব্লাড বইয়ে উল্লেখ করেন যে ১১৪৩ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কোন কোন সুত্র মতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের রাত জেগে জেগে ফাঁসির আদেশে সই করতে হতো সেই সময়। এটা তার কাছে অবশ্য তেমন কঠিন কিছু না, মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় ও নিপীড়নে তিনি ততদিনে সিদ্ধহস্ত।
টেলিফিল্মের শুরুতে একটা জায়গায় বিমানসেনার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী বলেন - জাসদ সেনাবাহিনীর ভেতর ঢুইকা ঝামেলা সৃষ্টি করতেসে। গতকাল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করসে, এয়ারপোর্ট আক্রমণ করসে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সাহসী মানুষ, আরেকবার সাহসের পরিচয় দিলেন এই ডায়লগ অন্তর্ভুক্ত করে। জাসদের বা কর্নেল তাহেরের ডিসট্রাকটিভ এ্যপ্রোচ মেইনস্ট্রিমে তুলে আনার ব্যাপারে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সবসময়ই লাজুক। জাসদের বা কর্নেল তাহেরের দেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া রোমান্টিসাইজড বিপ্লব হিসেবে দেখে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাসদ সরকারের রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে পদে পদে বিব্রত করেছে, গণআন্দোলন করে সরকারের পতন চেয়েছে, সেনাবাহিনীর ভেতর গোপণ বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তুলেছে, ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফাটিয়েছে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হবার পর রেডিওস্টেশনে যেয়ে ডালিমের সাথে আলোচনা করেছে, ৭ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে বিপ্লব করে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, আবার জিয়া বেকে বসলে ৮ নভেম্বর রাতে আফিসারদের হত্যা করেছে। গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় এসব উঠে আসে বিপ্লবের রোমান্টিকতায়, এবারই প্রথম বোধহয় উঠে এলো দোষারোপ স্বরে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টীমকে সাধুবাদ!
তথ্য সূত্রঃ
Bangladesh A Legacy of Blood
Anthony Mascarenhas
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ
সেনা অভ্যুত্থানসমূহের সব তথ্য জানানো হোক
জিয়ার নির্দেশেই বিমানবাহিনীতে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
জিয়ার দুঃশাসন : বাংলাদেশের কলঙ্ক
বাহাত্তরের বাংলাদেশঃ জাতীয় দ্বিধাবিভক্তির খোঁজে-পর্ব ১
১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ও সাপ্লাই কোরের সৈনিকরা এবং বিমানবাহিনীর সৈনিকরা যে বিদ্রোহ করে, তাতে তারা বিদ্রোহের প্রথম প্রহরেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১১ জন অফিসার ও এক অফিসারের ১৬ বছরের ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। নিশ্চিত ভাবেই সে প্রহরে ফিরে এসেছিল '৭৫ এর ৭ নভেম্বরের রক্তনেশা - অফিসারের রক্ত চাই, সৈনিক-সৈনিক ভাই ভাই। কিন্তু সরকার ( জিয়াউর রহমান তখন দেশের সর্বময় কর্তা এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ) সমর্থিত সেনাদল দ্রুত তেজগাঁও বিমানবন্দর দখল নেয়, রেডিও স্টেশন দখল নেয়, বিদ্রোহের মূল হোতাদের গ্রেফতার করে। দ্বিতীয় প্রহরেই স্তিমিত হয়ে যায় দেশের দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লব।
দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লবের পরের ইতিহাস করুণ। জিয়াউর রহমান-মীর শওকত-মঞ্জুর গংয়ের নির্দেশে জাসদের ও বামপন্থীদের বীজ সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে উপড়ে ফেলার চেস্টা হিসেবে অতিস্বল্প সময়ের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় কয়েকশো, মতান্তরে কয়েক হাজার বিমানসেনাদের যাদের বেশীরভাগেরই কোন পন্থার সাথে পরিচয় ছিল না, ছিলো না কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ । তাদের দোষ যা ছিল তা হলো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ( কুর্মিটোলা বেইস ও তেজগাঁও বিমানবন্দর ) উপস্থিত থাকা । আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন রকম সুযোগ পায়নি এসব অভিযুক্তরা। কোন কোন বিচার কাজ শেষ হয়েছে ১০ মিনিটের মধ্যে, রায় - ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াড। লাশ দেয়া হয়নি পরিবারের কাছে; একই গর্তে হিন্দু, মুসলিম একাধিক লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে; কোন রেকর্ড রাখা হয়নি, কবরের ফলক তো দূরের কথা।
ফায়ারিং স্কোয়াডের পাল্লায় পরা এক বিমানসেনা ও তার স্ত্রীর স্ট্রাগেল নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিফিল্ম আয়শা। আমাদের ফিল্মমেকাররা আসলে শিখে গেছেন যা বলতে পারা যায় না, সেটা কীভাবে বলে ফেলা যায়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী চমৎকার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এ ব্যাপারে। আয়শা টেলিফিল্মে তিনি বলে ফেলেছেন অনেককিছু। তবে টেলিফিল্মটি আরও এনগেজিং হতো যদি বিমানবাহিনীর প্রচলিত জারগন ব্যবহার করা হতো, চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রটিকে আর একটু ফুটিয়ে তুললে এবং ন্যারেটিভে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরলে।
১৯৭৭ সালের ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত না এমন দর্শকদের কাছে টেলিফিল্মটি একরকম আবেদন নিয়ে এসেছে আর যারা সেইসময়ের ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত তাদের কাছে ভিন্ন আবেদন নিয়ে এসেছে। চঞ্চল চৌধুরী শাস্তি পাওয়া বিমানসেনার চরিত্রে সাবলীল নন এবং তার স্ক্রিন উপস্থিতি তুলনামূলক ভাবে কম। রিফাত চৌধুরী দুলাভাই চরিত্রে দারুন অভিনয় করেছেন আর দারুন করেছেন প্রবীণ সৈনিকের চরিত্রদানকারী অভিনেতা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ ফুটিয়ে তোলার জন্য যা প্রয়োজন, তার সবটাই করেছেন। সীমাব্ধতা ছিল নিশ্চয়ই, তিনি সেগুলো অতিক্রম করে যা বলতে চেয়েছেন, যা দেখাতে চেয়েছেন, পেরেছেন। তিশা শাস্তি পাওয়া বিমানসেনার স্ত্রীর চরিত্রে অনবদ্য। স্বামীকে সামরিক কর্তৃপক্ষ মেরে ফেলেছে জেনে অন্তসত্তা তিশা দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে যখন প্রশ্ন করেছেন - বুকে গুলি করসেন না মাথায়, স্যার?, আমি কেঁদে ফেলেছি। আর এক জায়গায় তিনি বলেন -আমি তো জানি না আমার স্বামীকে কোথায় কবর দিয়েছে তাই আমি যেখানেই মোনাজাত ধরব, আল্লাহ কবুল করে নেবেন। আমি জানি না তিশা বা ফারুকী ১৯৭৭ সালের হারিয়ে যাওয়া সৈনিকদের আপনজনদের সাথে দেখা করেছিলেন কিনা প্রিপারেশন হিসাবে। হয়তো করেছেন। বিমানবাহিনীর সেইসব হতভাগ্য সৈনিকদের আপনজনেরা এখনো দেশের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁচে আছেন যারা জানেন না, তাদের বাবা, তাদের স্বামী, তাদের সন্তানদের কবর কোথায় বা আদো কবর দেয়া হয়েছিল কিনা।
'বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস' নামে এক বই বের হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, বা যাদের কাছে আছে তারা স্বীকার করেন না যে আছে তাদের কাছে। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সেই বইয়ের প্রায় সব কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ৫৬১ জন সৈনিককে ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয় । ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ৪০০ থেকে ৫০০ সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সেই একই সময়ে তৎকালীন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন যে বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন বিমান সদস্যের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড ও ২৪৭ জনকে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি প্রদান করেছিল মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনাল। লন্ডন টাইমস ১৯৭৮ সালে রিপোর্ট করে যে ঐ ঘটনায় প্রায় ৬০০ জনকে ফাঁসির মাধ্যমে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। আর অভিযুক্ত কয়েকজনের ভাষ্যমতে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী দুই মাসে এক হাজার চারশো সৈনিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মারা হয়। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার লিগ্যাসি অব ব্লাড বইয়ে উল্লেখ করেন যে ১১৪৩ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কোন কোন সুত্র মতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের রাত জেগে জেগে ফাঁসির আদেশে সই করতে হতো সেই সময়। এটা তার কাছে অবশ্য তেমন কঠিন কিছু না, মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় ও নিপীড়নে তিনি ততদিনে সিদ্ধহস্ত।
টেলিফিল্মের শুরুতে একটা জায়গায় বিমানসেনার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী বলেন - জাসদ সেনাবাহিনীর ভেতর ঢুইকা ঝামেলা সৃষ্টি করতেসে। গতকাল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করসে, এয়ারপোর্ট আক্রমণ করসে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সাহসী মানুষ, আরেকবার সাহসের পরিচয় দিলেন এই ডায়লগ অন্তর্ভুক্ত করে। জাসদের বা কর্নেল তাহেরের ডিসট্রাকটিভ এ্যপ্রোচ মেইনস্ট্রিমে তুলে আনার ব্যাপারে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সবসময়ই লাজুক। জাসদের বা কর্নেল তাহেরের দেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া রোমান্টিসাইজড বিপ্লব হিসেবে দেখে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাসদ সরকারের রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে পদে পদে বিব্রত করেছে, গণআন্দোলন করে সরকারের পতন চেয়েছে, সেনাবাহিনীর ভেতর গোপণ বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তুলেছে, ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফাটিয়েছে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হবার পর রেডিওস্টেশনে যেয়ে ডালিমের সাথে আলোচনা করেছে, ৭ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে বিপ্লব করে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, আবার জিয়া বেকে বসলে ৮ নভেম্বর রাতে আফিসারদের হত্যা করেছে। গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় এসব উঠে আসে বিপ্লবের রোমান্টিকতায়, এবারই প্রথম বোধহয় উঠে এলো দোষারোপ স্বরে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টীমকে সাধুবাদ!
তথ্য সূত্রঃ
Bangladesh A Legacy of Blood
Anthony Mascarenhas
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ
সেনা অভ্যুত্থানসমূহের সব তথ্য জানানো হোক
জিয়ার নির্দেশেই বিমানবাহিনীতে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
জিয়ার দুঃশাসন : বাংলাদেশের কলঙ্ক
বাহাত্তরের বাংলাদেশঃ জাতীয় দ্বিধাবিভক্তির খোঁজে-পর্ব ১
Comments
Las Vegas Casino & 부천 출장마사지 Hotel. 3131 South Las Vegas 김해 출장샵 Blvd. South, Las Vegas, NV 오산 출장안마 89109. Directions · (702) 770-7000. Call Now · 과천 출장마사지 More Info. Hours, Accepts Credit Cards, 경상북도 출장샵 Parking, Rating: 2 · 4,181 votes