সিদ্দিক বন্ধুর বাসায় মদ খায় ও ভিসিআরে কামুক রেখার নাচ দেখে, সে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বান্ধবীর শরীর ছুঁতে পারবে বলে বেবিটেক্সিতে ওঠে, সে ধানমন্ডির অভিজাত লনপার্টিতে দাঁড়িয়ে চোখ বড়বড় করে স্লিভলেস ব্লাউজ পরা মহিলা দেখে চোখ জুড়ায়, সে অফিসের বড় সাহেবের স্ত্রীর ইঙ্গিতে পা বাড়ায় নিষিদ্ধ সম্পর্কে।
সিদ্দিক রাজনীতিতে জড়িত হতে চায় না কিন্তু তার বান্ধবীকে ইমপ্রেস করার জন্য রাজনৈতিক সভায় যায়। রাজনীতির ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা তাকে ব্যথিত করে না কারণ প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতন হলেও তার কিছু যায় আসে না, পতন না হলেও না।
গল্পের নায়কের চরিত্র, আচরণ যেমন 'নায়ক' সুলভ হওয়া প্রয়োজন সিদ্দিকেরটা তেমন নয়। বরং এক সময় মনে হতে থাকে সে চারিত্রিকভাবে কিঞ্চিত লম্পট। গল্পের নাম অনেক বড় এবং নামের একাংশে সিদ্দিকের উপস্থিতি প্রবল। গল্পের নামের অন্যঅংশে সিদ্দিক ঢুকতে চায় না, শেষ পর্যন্ত ঢুকেও না কিন্তু স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়েই সিদ্দিকের দুঃসময়ের সমাপ্তি হয়।
আমি মানতে নারাজ সিদ্দিক লম্পট। সে চাকরিতে ফাঁকি দেয় না, মনে প্রানে মালিকের উন্নতি কামনা করে এবং বাড়তি ইনকামের জন্য প্রাইভেট পড়ায় যদিও সেটা অফিসে জানায় না। এতে কি প্রমাণ হয় সে লম্পট?
সিদ্দিক সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করে আর প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধুর বাসায় কামুক ছবি দেখে। এতে কি প্রমাণ হয় সে লম্পট?
তবে নারী সংক্রান্ত ঘটনাবলী সিদ্দিকের চরিত্র একটু প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু বান্ধবীর শরীর ছুঁতে চাওয়া কি তাকে লম্পট হিসেবে প্রকাশ করে? ১৯৯০ সালে সিদ্দিক কি একমাত্র প্রেমিক যে বেবী ট্যাক্সিতে বসে প্রেমিকার শরীর ছুয়েছে? আশি ও নব্বই দশকে ধানমন্ডি, গুলশানের অনেক বাসায় লন পার্টি হতো সন্ধ্যায়, যেখানে ওয়াইন সারভ করা হতো। সিদ্দিক এরকম একটি পার্টিতে যেয়ে পড়ে এবং একটু মদ খেয়েই মাতাল হয় আর মাতাল হয়ে সে সুন্দরী নারী দেখতে থাকে। এতে কি প্রকাশ পায় সে লম্পট? সকল পুরুষই কি সুন্দরী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় না? কবি বলেছেন - তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি সেকি মোর অপরাধ? অবশ্য যে কবি এটা বলেছেন তার চরিত্রও বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে স্লিভলেস ব্লাউজ কোন নারীর দিকে তাকিয়ে থাকা কোন মানদন্ডেই লম্পটতা হতে পারে না।
রোকেয়ার সাথে সিদ্দিকের সম্পর্ক বেশি দিনের না। সম্পর্ক খুব একটা গভীরও নয়। তাই শাহানার কাছ থেকে প্রেমের ইঙ্গিত পেয়ে সিদ্দিক পা বাড়ায় সেদিকে। রোকেয়ার সাথে অনেকদিন দেখা হয় না, রোকেয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত তাই সিদ্দিক শাহানার সংস্পর্শ হেলায় হারাতে চায় না।
শাহানা বিবাহিত এটা সিদ্দিকের সমস্যা নয়। সিদ্দিক মনে করেছে বিবাহিত মহিলাদের ইমপ্রেস করা সহজ। যেসব বিবাহিত মহিলা করুণা চায় এই বলে যে তাদের স্বামী তাদের সময় দেয় না, তাদেরকে 'you deserve to be happy' বললে মামলা অনেক এগিয়ে যাবে, ভাবে সিদ্দিক। তাই সে অপেক্ষা করতে থাকে শাহানা বলবে - 'মফিজুল আমাকে সময় দেয় না' অথবা 'আমি খবর পেয়েছি মফিজুল হোটেল রুমে মেয়ে নিয়ে যায়।' কিন্তু শাহানা তা বলে না আর সিদ্দিকের ও বলা হয়ে ওঠেনা 'you deserve to be happy'। ফলশ্রুতিতে তার দুঃসময় প্রলম্বিত হয়।
আমি কোন গল্পই একবসাতে লিখতে পারিনা যত ছোট গল্প হোক না কেন। একটু লিখি, একটু ভাবি, অন্য কাজে চলে যাই, অন্য গল্প লেখা শুরু করি, আবার পুরনো গল্পে ফেরত আসি, ভাবি, কিছু পরিবর্তন করি, আবার অন্য কাজে চলে যাই, আবার ভাবি, দিন মাস পার হয়, ফিরে আসি আবার আগের লেখায়। ভাবনায় শব্দের পর শব্দ না সাজিয়ে আমি লিখতে পারি না। এই তরিকায় চলি দেখে এক একটা গল্প শেষ হতে অনেক সময় লাগে।
'সিদ্দিকের দুঃসময় ও স্বৈরাচার পতনের প্রয়োজনীয়তা' গল্পটার শুরু আর শেষের পার্থক্য দেড় বছর। অল্প অল্প করে লিখেছিলাম।
এই গল্পের শেষটা আমার খুব পছন্দের। আমার ধারনা খুব কম পাঠক-পাঠিকা ধরতে পেরেছেন গল্পটি কোন দিকে যাচ্ছে। গল্পের শেষটা আমি এক বসাতেই লিখেছিলাম, কাটাকাটি করতে হয়নি, পরিবর্তন করতে হয়নি।
তবে গল্পের শুরুটা এমন ছিল না। শুরুতে ছিল সিদ্দিকের আর রোকেয়ায় বেবিটেক্সিতে উত্তরা যাবার সময়ের কথোপকথনটি। শরীর ছোবার আগ-মুহূর্তে রোকেয়া যে প্রশ্নটি করে যার ফলে সিদ্দিকের থমকে যেতে হয়, সেখান থেকে ছিল গল্পটির শুরু।
এরশাদের পতনের সময় আমি ক্লাস ছাত্র সিক্সের ছাত্র। আমাকে একজন প্রাইভেট টিউটর পড়াতেন - মেধাবী ছাত্র, সেশনজটে অতিষ্ঠ। ছাত্রদল করতেন তিনি। সময় পেলে আমাকে জানাতেন কি হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে। একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন - আমার কি মনে হয় শেখ হাসিনা ভালো নেত্রী নাকি খালেদা জিয়া। আমার তখন এডল্যাসেন্ট বয়স। রাজনীতি বুঝিনা। উত্তর দিয়েছিলাম - খালেদা জিয়া দেখতে অনেক সুন্দর তাই তিনিই ভালো নেত্রী। হতে পারে ছোটবেলার সেই প্রেফারেন্সই সিদ্দিক আর রোকেয়ার কথোপকথনের মধ্যে উঠে এসেছে। গল্পটা আসলে এই কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে।
এখন এই ২০১৮তে দাঁড়িয়ে এটা স্বচ্ছ টলটল পানির মত পরিষ্কার কোন নেত্রী পরিপক্ক, কোন নেত্রী বিচক্ষণ আর কোন নেত্রী দেউলিয়া।
'সিদ্দিক এখন' নামে একটা গল্প লেখা যেতে পারে যেখানে সিদ্দিক ২০০০ দশকের একজন কর্পোরেট হর্তাকর্তা হয়ে কিভাবে কলিগদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে এবং তা কাজে লাগিয়ে sensitive information সংগ্রহ করে তার বর্ণনা থাকবে। ক্যারিয়ারে তরতর করে উঠে যাওয়া সিদ্দিক গল্পের একদম শেষে মুখোমুখি হবে রোকেয়ার যে একটা অডিট ফার্মে অথবা দুদকে চাকরী করে। সিদ্দিক পুরনো সম্পর্কের জের ধরে রোকেয়ার কাছে আর্জি করবে তার বিরুদ্ধে থাকা সব তথ্য নষ্ট করে দিতে। রোকেয়ার উত্তর হবে গল্পের শেষ লাইন ও ক্লাইম্যাক্স। গল্পের মাঝামাঝি কোনো এক সময় আসতে পারে শাহানা যে এখনো আগের মতো এট্রাকটিভ আছে, এখনো আগের সংসারেই আছে এবং এখনও অনেক পুরুষের ঘুম নষ্ট করে।
'সিদ্দিকের দুঃসময়ে ও স্বৈরাচার পতনের প্রয়োজনীয়তা' গল্পের ছন্দা চরিত্রটিকে 'সিদ্দিক এখন' গল্পে আনব না কারণ তাকে নিয়ে একটি গল্প ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছি। গল্পের নাম 'ছন্দার সুসময় ও পরিবারতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা'।
Comments