ছয়জন সশস্ত্র যুবক দুইদলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডে ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে। সময় সকাল ৯ টা। তারিখ ২৬ নভেম্বর, ১৯৭৫। পরনে তাদের পরিপাটি পোশাক, পোশাকের নিচে অস্ত্র আর সাথে আছে ব্যাগ, যার ভেতরে নাইলনের দড়ি, ছুরি আর দাবি-দাওয়া সম্বলিত কাগজ। দলের চারজনকে অস্থির দেখালেও দুইজনকে দেখায় খুব ধীর স্থির। তাদের পরিচয় দুই প্রকার; একটিতে রয়েছে বাবা-মা প্রদত্ত নাম, যা এখানে গৌণ, এবং অন্যটিতে রয়েছে, যেটা এখানে মুখ্য, তারা কোন সংস্থার সদস্য।বাবা-মা'র দেয়া নাম অনুযায়ী তারা বাহার, বেলাল, বাচ্চু, সবুজ, হারুন ও মাসুদ। তবে তাদের মুখ্য পরিচয় তারা জাসদের গণবাহিনীর সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য।
নভেম্বরের শেষদিক। বেশ শীত পড়েছে এবার। তবে আজ সকালে সূর্যের তেজ আছে, বেশ উষ্ণ একটা ভাব আছে চারদিকে। ভারতীয় হাই কমিশনের কাছে দুই দলে ভাগ হওয়া ছয়জন যুবকের শরীর আজ মাত্রাঅতিরিক্ত গরম; তারা বিপদজনক এক মিশনে এসেছে আজ। তারা এসেছে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে কিডন্যাপ করতে। উদ্দেশ্য জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত সরকারকে চাপে ফেলে কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করা। দুইদিন আগে, অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীবাহিনী তাহেরকে গ্রেফতার করেছে।
এই অভিযানের নির্দেশদাতা ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন। তিনি কর্নেল তাহেরের ভাই। ছয়জনের এই স্কোয়াডের বাহার ও বেলালও কর্নেল তাহেরের ভাই। তারা আজ দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ - কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করতেই হবে। ঢাকা নগর গণবাহিনী তৈরি হয়েছিল সরকারকে উৎখাত করবার জন্য তবে টার্গেট ছিল মুজিব সরকার। ১৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে গণবাহিনীর টার্গেটও পরিবর্তন হয়। তারা কিছু করবার আগেই তিন নভেম্বর আবার ক্ষমতার পালাবদল হয়। গণবাহিনী তাদের কামড় দেয় ৭ নভেম্বর। ক্ষমতার কাছে যায় তারা কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাবার আগে জিয়াউর রহমান তা ছিনিয়ে নেন। তাহের বেপরোয়া হয়ে জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। জিয়া ক্ষেপে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দেন জাসদ ও গণবাহিনীর সব নেতাকে গ্রেফতারের।
তাহেরের গ্রেফতার জাসদ ও গণবাহিনীর কফিনের ডালা লাগিয়ে দেয়। কফিনে শেষ পেরেক স্পর্শ পাবার আগেই কিছু একটা করে মুক্ত করতে হবে তাহেরকে এ ভাবনা থেকেই সমর সেনকে কিডন্যাপ করার এই মারাত্মক পরিকল্পনা। তবে কোনো না কোনো রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার কথা আগেও দলীয় সভায় আলোচনা করা হয়েছিল। প্রাথমিক টার্গেট ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার। গণবাহিনীর সুইসাইড স্কোয়াড আগে থেকেই বোস্টার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে রেখেছিল। নভেম্বরের ২৪ তারিখ তাহের গ্রেপ্তার হলে এই স্কোয়াড সেদিন রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় কোন এক প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে হবে। প্রভাবশালী তিন দেশের কথা উঠে এসেছিল - মার্কিন, রুশ, ভারত। বাহার যে কিনা এই স্কোয়াডের প্রধান, জানতে চেয়েছিল এই তিন দেশের রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে কি কি তথ্য আছে তাদের কাছে। বাহারকে অন্য সব সদস্যরা জানিয়েছিল যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসা ধানমন্ডি মাঠের উল্টো দিকে। সেখান থেকে প্রতিদিন আটটায় তিনি রওনা হন অফিসের উদ্দেশ্যে। মার্কিন দূতাবাস অবস্থিত মতিঝিলের আদমজী কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায়। তারা আরো জানিয়েছিল বোস্টার বেশ ফিট একজন মানুষ। প্রতিদিন সকালে এক ঘন্টা জগিং করেন তিনি। আবার অফিসে লিফট ব্যবহার করেন না, পাঁচতলার হেঁটেই ওঠেন। বাকি দুই রাষ্ট্রদূতের চলাফেরার ওপর গণবাহিনীর কাছে তেমন কোনো তথ্য ছিল না তারপরও সুইসাইড স্কোয়াড সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন কে কিডন্যাপ করবে। এর কারণ তাতে একসাথে দুই কাজ হবে; এক- সরকারকে চাপে ফেলে তাহেরের মুক্তি; দুই - জাসদযে ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় চলেনা তা প্রমাণ করা।
২৫ নভেম্বর বাহার ও বেলাল এসেছিলো ভারতীয় দূতাবাসে। রিসিপশনে বাহার বলেছিলো বন্ধুরা মিলে বিশ্ব ভ্রমণে বের হতে চায় তারা যার শুরু করবে ভারত দিয়ে। প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিল এ ব্যাপারে কোন অফিসারের সাথে কথা বলতে হবে। পরদিন সকালে দশটার আসতে বলা হয় তাদের। ২৫ তারিখ রাতেই সুইসাইড স্কোয়াডের ছয় সদস্য বসে মগবাজারের নয়াটোলায় অবস্থিত এক বাসায়। কয়েকটি জায়গা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো একে অপরের সাথে শেয়ার করে নেয় তারা। তাদের জানা তথ্য মতে সমর সেন সকাল নয়টার কিছুপর অফিসে আসেন। তিনি থাকেন গুলশানে। গুলশান থেকে ধানমন্ডি আসতে তার ১৮ থেকে ২০ মিনিট লাগে। তার সাথে থাকে চারজন বডিগার্ড। এই চারজন সমর সেনের গাড়ীর পেছনে পেছনে একটা জীপে করে ভ্রমণ করে। যে তথ্য তাদের জানা হয়নি তা হলো ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর একটি দল সার্বক্ষণিক ভারতীয় দূতাবাসের দোতালায় পাহারা দেয়। সবুজ বলেছিলো অফিসে আসার পথেই সমর সেনকে কিডন্যাপ করলে ভালো হয় কিন্তু বাহার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলো "রাস্তা থেকে কিডন্যাপ করে যেই বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হোক না কেন নিরাপত্তারক্ষীবাহিনী rescue mission এর নামে সমর সেন সহ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে আর তাছাড়া ভারতীয় দূতাবাসে কিডন্যাপ করলে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করা যাবে দুই দেশের সরকারের সাথে।
সেই পরিক্রমায় তারা ছয়জন উপস্থিত আজ এখানে। উদ্দেশ্য বিশ্ব ভ্রমন নিয়ে কথা বলা নয়; উদ্দেশ্য সমর সেনকে কিডন্যাপ করা। একটা দল, যেখানে আছে বাহার, বেলাল ও সবুজ, দাঁড়ায় German cultural center এর কাছে। অন্যদলটি দাঁড়ায় ভারতীয় ভিসা অফিসের কাছে। সবুজের পানির পিপাসা লাগে। সে প্রশ্ন করে "বাহার ভাই, একটু পানি খেয়ে আসি?" বাহার অনুমতি দেয় না; বলে "এখন position ছেড়ে কোথাও যাস না, সমর সেন যেকোনো সময় চলে আসবে।"
অন্যদলের বাচ্চুকে খানিকটা আনমনা লাগে। হারুন জিজ্ঞেস করে "তুই ঠিক আসশ? তোরে আনমনা লাগে কেন?" বাচ্চু সম্বিত ফিরে পায়, বলে "আরে না, আমি ঠিক আছি।"
আসলে সে ভাবছিল পারুলের কথা। পারুল লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রী। থাকে হোস্টেলের দোতোলার একটা কামরায়। গত কয়েক মাসে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে পারুলের সাথে। বাচ্চু তিতুমীর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং এই স্কোয়াডের সদস্যদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সী। গতকাল সে দেখা করে এসেছে পারুলের সাথে। আসার সময় বলে এসেছে "আগামীকাল সকালে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, দুপুরে রেডিওর খবর শুনবেন।" আর কোনদিন ভিক্টোরিয়া পার্কে পাশাপাশি বসে পারুলের সাথে কথা হবে কিনা ভাবছিল বাচ্চু; হারুনের ধমকে বাস্তবে ফিরে আসে সে; কঠিন ভয়ংকর বাস্তবে।
সময় কাটতে চায় না। একে অপরের চোখাচোখি করে একটু পরপর, ঘড়িতে সময় দেখে।
সমর সেনকে নিয়ে গাড়ির বহর নয়টা পঁয়তাল্লিশে ধানমন্ডি এসে পৌঁছায়। দূর থেকে তা দেখে বাহার, বেলাল ও সবুজ ঢুকে যায় ভারতীয় দূতাবাসের চত্বরে। সমর সেনের গাড়ী এবং তার পেছনে থাকা বডিগার্ডদের বহন করা জীপ দূতাবাসের চত্বরের ভেতরে এসে দাঁড়ায়। জিপ থেকে চারজন বডিগার্ড নামে, তাদের কাধে ভারতীয় এসএমজি। হারুন, মাসুদ, বাচ্চু গাড়ীগুলোর পেছনে এসে দাঁড়ায়। বেলাল, বাহার ও সবুজ ততক্ষনে রিসেপসনের কাছে পৌঁছে গেছে। অফিসের এক স্টাফ এসে সমর সেনের গাড়ীর দরজা খুলে দিলে তিনি নেমে ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসেন। বেলাল এগিয়ে যায়। সমর সেনে সিঁড়িতে পা দেবার সাথে সাথেই বেলাল তাকে জাপটে ধরে। বাহার ও সবুজ অস্ত্র বের করে সমর সেনের কাছে যায়। বেলাল তার অস্ত্র বের করে চিৎকার করে বলে "আপনি আমাদের বন্দী; আপনার বডিগার্ডদের বলুন গুলি না করতে।" পেছনে চারজন বডিগার্ড হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে অন্য দলটি এগিয়ে এসেছে। সবুজ সমর সেনের এক হাত ধরে, বেলাল ধরে অন্য হাত, বাহার সমর সেনের গায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সামনে নিয়ে যায়। সমর সেনকে আতঙ্কিত দেখায় কিন্তু তিনি খুব একটা বাক্যব্যয় করেন না। আক্রমণকারীদের নির্দেশ অনুযায়ী সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকেন তার অফিসের দিকে।
দোতালার প্যাসেজে ততক্ষনে পজিশন নিয়ে নিয়েছে দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষাকারী ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা। সমর সেন সিঁড়ির মাঝামাঝি এলে কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথমে গুলি লাগে বাহারের গায়ে; সে সিড়ি থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। বেলাল ও সবুজ সামনে থাকাতে দৌড়ে উপরে উঠে দুজন নিরাপত্তারক্ষীকে জাপটে ধরে, বেঁচে যায় মৃত্যুর হাত থেকে। কিন্তু হারুন, মাসুদ ও বাচ্চু যারা পেছনে ছিল তাদের ভাগ্য মন্দ। তাদের গুলি করা হয় সামনে এবং পিছন দিক থেকে, এসএমজির গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় তাদের দেহ। বাচ্চু এক চোখে বিপ্লব আর অন্য চোখে পারুলের জন্য ভালবাসা নিয়ে নিথর পড়ে থাকে। ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীবাহিনী যখন তার উপুত হওয়া দেহ পা দিয়ে উল্টায় তখন বাচ্চুর দুই চোখই খোলা।
ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী বেলাল ও সবুজকে আটকে রাখে একটি কক্ষে এবং বাকি চারজনের মৃতদেহ নিয়ে রাখে দূতাবাসের বাইরে।
এর পরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। পুলিশ আসে, বাহার, হারুন, মাসুদ ও বাচ্চুর মৃতদেহ নিয়ে যায় তিন নম্বর রোডে, সেখানেই ধানমন্ডি থানা। সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর, যিনি খালেদ মশাররফের স্থানাভিসিক্ত হয়েছেন, আসেন ধানমন্ডিকে। বেলাল ও সবুজকে নিয়ে যান সেনানিবাসে। বেলা ১১টার দিকে স্বয়ং সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ধানমন্ডি আসেন। মৃতদেহগুলো তখন থানার সামনে একটি ভ্যানে রাখা। জিয়াউর রহমান মৃতদেহগুলোর পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। কর্নেল তাহেরের সূত্রেই বাহারের সঙ্গে তাঁর একপ্রকারের সখ্য ছিল। অসম বয়সী জিয়া ও বাহার মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। বন্ধুর মৃত্যুদেহ দেখে জিয়া ব্যথিত হন।
ভারতীয় হাইকমিশনে এই অভিযানের খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এর সমালোচনা করেন। জনমতও জাসদের বিপক্ষে চলে যায়। জাসদের নেতারা হতভম্ব হয়ে যান কারন তারা কেউ এই আভিযানের কথা জানতেনই না, অনুমোদন করা তো দূরের কথা। ঢাকা শহরের কিছু দূরে বেরাইদ নামের এক গ্রামে ঢাকা নগর গণবাহিনীর এক সভা ডাকা হয় কিছুদিন পর। আনোয়ার হোসেন সেখানে ঘটনার দায় স্বীকার করেন। অধিকাংশ সদস্য আনোয়ারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর দাবি জানান কিন্ত কি এক কারনে তাঁকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তিটি হলো নগর গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া। কিছুদিন পরে জাসদের পার্টি ফোরাম থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের অভিযানের ব্যাপারে একটি সার্কুলার প্রকাশ করা হয় সেখানে অভিযান টিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর সাথে সাথে বলা হয় যারা এটা করেছে তারা বিপ্লবীও নয়, প্রতিবিপ্লবী ও নয়, তারা হচ্ছে অবিপ্লবী।
এ ঘটনার পর জাসদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর গুলোর সাঁড়াশি অভিযান আরো বেড়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করে আখলাকুর রহমান, মোঃ শাহজাহান আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না সহ অন্যান্য সংগঠকদের। এর মাধ্যমে জাসদের কফিনে শেষ পেরেকগুলো গেঁথে যায়।
তথ্য সুত্রঃ
জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি
মহিউদ্দিন আহমেদ
ক্রাচের কর্নেল
শাহাদুজ্জামান
নভেম্বরের শেষদিক। বেশ শীত পড়েছে এবার। তবে আজ সকালে সূর্যের তেজ আছে, বেশ উষ্ণ একটা ভাব আছে চারদিকে। ভারতীয় হাই কমিশনের কাছে দুই দলে ভাগ হওয়া ছয়জন যুবকের শরীর আজ মাত্রাঅতিরিক্ত গরম; তারা বিপদজনক এক মিশনে এসেছে আজ। তারা এসেছে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে কিডন্যাপ করতে। উদ্দেশ্য জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত সরকারকে চাপে ফেলে কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করা। দুইদিন আগে, অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীবাহিনী তাহেরকে গ্রেফতার করেছে।
এই অভিযানের নির্দেশদাতা ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন। তিনি কর্নেল তাহেরের ভাই। ছয়জনের এই স্কোয়াডের বাহার ও বেলালও কর্নেল তাহেরের ভাই। তারা আজ দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ - কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করতেই হবে। ঢাকা নগর গণবাহিনী তৈরি হয়েছিল সরকারকে উৎখাত করবার জন্য তবে টার্গেট ছিল মুজিব সরকার। ১৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে গণবাহিনীর টার্গেটও পরিবর্তন হয়। তারা কিছু করবার আগেই তিন নভেম্বর আবার ক্ষমতার পালাবদল হয়। গণবাহিনী তাদের কামড় দেয় ৭ নভেম্বর। ক্ষমতার কাছে যায় তারা কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাবার আগে জিয়াউর রহমান তা ছিনিয়ে নেন। তাহের বেপরোয়া হয়ে জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। জিয়া ক্ষেপে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দেন জাসদ ও গণবাহিনীর সব নেতাকে গ্রেফতারের।
তাহেরের গ্রেফতার জাসদ ও গণবাহিনীর কফিনের ডালা লাগিয়ে দেয়। কফিনে শেষ পেরেক স্পর্শ পাবার আগেই কিছু একটা করে মুক্ত করতে হবে তাহেরকে এ ভাবনা থেকেই সমর সেনকে কিডন্যাপ করার এই মারাত্মক পরিকল্পনা। তবে কোনো না কোনো রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার কথা আগেও দলীয় সভায় আলোচনা করা হয়েছিল। প্রাথমিক টার্গেট ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার। গণবাহিনীর সুইসাইড স্কোয়াড আগে থেকেই বোস্টার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে রেখেছিল। নভেম্বরের ২৪ তারিখ তাহের গ্রেপ্তার হলে এই স্কোয়াড সেদিন রাতেই সিদ্ধান্ত নেয় কোন এক প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে হবে। প্রভাবশালী তিন দেশের কথা উঠে এসেছিল - মার্কিন, রুশ, ভারত। বাহার যে কিনা এই স্কোয়াডের প্রধান, জানতে চেয়েছিল এই তিন দেশের রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে কি কি তথ্য আছে তাদের কাছে। বাহারকে অন্য সব সদস্যরা জানিয়েছিল যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসা ধানমন্ডি মাঠের উল্টো দিকে। সেখান থেকে প্রতিদিন আটটায় তিনি রওনা হন অফিসের উদ্দেশ্যে। মার্কিন দূতাবাস অবস্থিত মতিঝিলের আদমজী কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায়। তারা আরো জানিয়েছিল বোস্টার বেশ ফিট একজন মানুষ। প্রতিদিন সকালে এক ঘন্টা জগিং করেন তিনি। আবার অফিসে লিফট ব্যবহার করেন না, পাঁচতলার হেঁটেই ওঠেন। বাকি দুই রাষ্ট্রদূতের চলাফেরার ওপর গণবাহিনীর কাছে তেমন কোনো তথ্য ছিল না তারপরও সুইসাইড স্কোয়াড সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন কে কিডন্যাপ করবে। এর কারণ তাতে একসাথে দুই কাজ হবে; এক- সরকারকে চাপে ফেলে তাহেরের মুক্তি; দুই - জাসদযে ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় চলেনা তা প্রমাণ করা।
২৫ নভেম্বর বাহার ও বেলাল এসেছিলো ভারতীয় দূতাবাসে। রিসিপশনে বাহার বলেছিলো বন্ধুরা মিলে বিশ্ব ভ্রমণে বের হতে চায় তারা যার শুরু করবে ভারত দিয়ে। প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিল এ ব্যাপারে কোন অফিসারের সাথে কথা বলতে হবে। পরদিন সকালে দশটার আসতে বলা হয় তাদের। ২৫ তারিখ রাতেই সুইসাইড স্কোয়াডের ছয় সদস্য বসে মগবাজারের নয়াটোলায় অবস্থিত এক বাসায়। কয়েকটি জায়গা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো একে অপরের সাথে শেয়ার করে নেয় তারা। তাদের জানা তথ্য মতে সমর সেন সকাল নয়টার কিছুপর অফিসে আসেন। তিনি থাকেন গুলশানে। গুলশান থেকে ধানমন্ডি আসতে তার ১৮ থেকে ২০ মিনিট লাগে। তার সাথে থাকে চারজন বডিগার্ড। এই চারজন সমর সেনের গাড়ীর পেছনে পেছনে একটা জীপে করে ভ্রমণ করে। যে তথ্য তাদের জানা হয়নি তা হলো ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর একটি দল সার্বক্ষণিক ভারতীয় দূতাবাসের দোতালায় পাহারা দেয়। সবুজ বলেছিলো অফিসে আসার পথেই সমর সেনকে কিডন্যাপ করলে ভালো হয় কিন্তু বাহার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলো "রাস্তা থেকে কিডন্যাপ করে যেই বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হোক না কেন নিরাপত্তারক্ষীবাহিনী rescue mission এর নামে সমর সেন সহ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে আর তাছাড়া ভারতীয় দূতাবাসে কিডন্যাপ করলে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করা যাবে দুই দেশের সরকারের সাথে।
সেই পরিক্রমায় তারা ছয়জন উপস্থিত আজ এখানে। উদ্দেশ্য বিশ্ব ভ্রমন নিয়ে কথা বলা নয়; উদ্দেশ্য সমর সেনকে কিডন্যাপ করা। একটা দল, যেখানে আছে বাহার, বেলাল ও সবুজ, দাঁড়ায় German cultural center এর কাছে। অন্যদলটি দাঁড়ায় ভারতীয় ভিসা অফিসের কাছে। সবুজের পানির পিপাসা লাগে। সে প্রশ্ন করে "বাহার ভাই, একটু পানি খেয়ে আসি?" বাহার অনুমতি দেয় না; বলে "এখন position ছেড়ে কোথাও যাস না, সমর সেন যেকোনো সময় চলে আসবে।"
অন্যদলের বাচ্চুকে খানিকটা আনমনা লাগে। হারুন জিজ্ঞেস করে "তুই ঠিক আসশ? তোরে আনমনা লাগে কেন?" বাচ্চু সম্বিত ফিরে পায়, বলে "আরে না, আমি ঠিক আছি।"
আসলে সে ভাবছিল পারুলের কথা। পারুল লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রী। থাকে হোস্টেলের দোতোলার একটা কামরায়। গত কয়েক মাসে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে পারুলের সাথে। বাচ্চু তিতুমীর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং এই স্কোয়াডের সদস্যদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সী। গতকাল সে দেখা করে এসেছে পারুলের সাথে। আসার সময় বলে এসেছে "আগামীকাল সকালে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, দুপুরে রেডিওর খবর শুনবেন।" আর কোনদিন ভিক্টোরিয়া পার্কে পাশাপাশি বসে পারুলের সাথে কথা হবে কিনা ভাবছিল বাচ্চু; হারুনের ধমকে বাস্তবে ফিরে আসে সে; কঠিন ভয়ংকর বাস্তবে।
সময় কাটতে চায় না। একে অপরের চোখাচোখি করে একটু পরপর, ঘড়িতে সময় দেখে।
সমর সেনকে নিয়ে গাড়ির বহর নয়টা পঁয়তাল্লিশে ধানমন্ডি এসে পৌঁছায়। দূর থেকে তা দেখে বাহার, বেলাল ও সবুজ ঢুকে যায় ভারতীয় দূতাবাসের চত্বরে। সমর সেনের গাড়ী এবং তার পেছনে থাকা বডিগার্ডদের বহন করা জীপ দূতাবাসের চত্বরের ভেতরে এসে দাঁড়ায়। জিপ থেকে চারজন বডিগার্ড নামে, তাদের কাধে ভারতীয় এসএমজি। হারুন, মাসুদ, বাচ্চু গাড়ীগুলোর পেছনে এসে দাঁড়ায়। বেলাল, বাহার ও সবুজ ততক্ষনে রিসেপসনের কাছে পৌঁছে গেছে। অফিসের এক স্টাফ এসে সমর সেনের গাড়ীর দরজা খুলে দিলে তিনি নেমে ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসেন। বেলাল এগিয়ে যায়। সমর সেনে সিঁড়িতে পা দেবার সাথে সাথেই বেলাল তাকে জাপটে ধরে। বাহার ও সবুজ অস্ত্র বের করে সমর সেনের কাছে যায়। বেলাল তার অস্ত্র বের করে চিৎকার করে বলে "আপনি আমাদের বন্দী; আপনার বডিগার্ডদের বলুন গুলি না করতে।" পেছনে চারজন বডিগার্ড হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে অন্য দলটি এগিয়ে এসেছে। সবুজ সমর সেনের এক হাত ধরে, বেলাল ধরে অন্য হাত, বাহার সমর সেনের গায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সামনে নিয়ে যায়। সমর সেনকে আতঙ্কিত দেখায় কিন্তু তিনি খুব একটা বাক্যব্যয় করেন না। আক্রমণকারীদের নির্দেশ অনুযায়ী সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকেন তার অফিসের দিকে।
দোতালার প্যাসেজে ততক্ষনে পজিশন নিয়ে নিয়েছে দূতাবাসের নিরাপত্তা রক্ষাকারী ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা। সমর সেন সিঁড়ির মাঝামাঝি এলে কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথমে গুলি লাগে বাহারের গায়ে; সে সিড়ি থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। বেলাল ও সবুজ সামনে থাকাতে দৌড়ে উপরে উঠে দুজন নিরাপত্তারক্ষীকে জাপটে ধরে, বেঁচে যায় মৃত্যুর হাত থেকে। কিন্তু হারুন, মাসুদ ও বাচ্চু যারা পেছনে ছিল তাদের ভাগ্য মন্দ। তাদের গুলি করা হয় সামনে এবং পিছন দিক থেকে, এসএমজির গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় তাদের দেহ। বাচ্চু এক চোখে বিপ্লব আর অন্য চোখে পারুলের জন্য ভালবাসা নিয়ে নিথর পড়ে থাকে। ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীবাহিনী যখন তার উপুত হওয়া দেহ পা দিয়ে উল্টায় তখন বাচ্চুর দুই চোখই খোলা।
ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী বেলাল ও সবুজকে আটকে রাখে একটি কক্ষে এবং বাকি চারজনের মৃতদেহ নিয়ে রাখে দূতাবাসের বাইরে।
এর পরের ঘটনা দ্রুত ঘটতে থাকে। পুলিশ আসে, বাহার, হারুন, মাসুদ ও বাচ্চুর মৃতদেহ নিয়ে যায় তিন নম্বর রোডে, সেখানেই ধানমন্ডি থানা। সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর, যিনি খালেদ মশাররফের স্থানাভিসিক্ত হয়েছেন, আসেন ধানমন্ডিকে। বেলাল ও সবুজকে নিয়ে যান সেনানিবাসে। বেলা ১১টার দিকে স্বয়ং সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ধানমন্ডি আসেন। মৃতদেহগুলো তখন থানার সামনে একটি ভ্যানে রাখা। জিয়াউর রহমান মৃতদেহগুলোর পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। কর্নেল তাহেরের সূত্রেই বাহারের সঙ্গে তাঁর একপ্রকারের সখ্য ছিল। অসম বয়সী জিয়া ও বাহার মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। বন্ধুর মৃত্যুদেহ দেখে জিয়া ব্যথিত হন।
ভারতীয় হাইকমিশনে এই অভিযানের খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এর সমালোচনা করেন। জনমতও জাসদের বিপক্ষে চলে যায়। জাসদের নেতারা হতভম্ব হয়ে যান কারন তারা কেউ এই আভিযানের কথা জানতেনই না, অনুমোদন করা তো দূরের কথা। ঢাকা শহরের কিছু দূরে বেরাইদ নামের এক গ্রামে ঢাকা নগর গণবাহিনীর এক সভা ডাকা হয় কিছুদিন পর। আনোয়ার হোসেন সেখানে ঘটনার দায় স্বীকার করেন। অধিকাংশ সদস্য আনোয়ারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর দাবি জানান কিন্ত কি এক কারনে তাঁকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তিটি হলো নগর গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া। কিছুদিন পরে জাসদের পার্টি ফোরাম থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের অভিযানের ব্যাপারে একটি সার্কুলার প্রকাশ করা হয় সেখানে অভিযান টিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর সাথে সাথে বলা হয় যারা এটা করেছে তারা বিপ্লবীও নয়, প্রতিবিপ্লবী ও নয়, তারা হচ্ছে অবিপ্লবী।
এ ঘটনার পর জাসদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর গুলোর সাঁড়াশি অভিযান আরো বেড়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করে আখলাকুর রহমান, মোঃ শাহজাহান আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না সহ অন্যান্য সংগঠকদের। এর মাধ্যমে জাসদের কফিনে শেষ পেরেকগুলো গেঁথে যায়।
তথ্য সুত্রঃ
জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি
মহিউদ্দিন আহমেদ
ক্রাচের কর্নেল
শাহাদুজ্জামান
Comments