নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার দিনে ডেলটা এয়ারলাইনসের একটি বিমান ( Delta Air Lines Flight 15) ২১৮ জন যাত্রী নিয়ে জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আটলান্টায় যাচ্ছিল। বিমানটির ক্যাপ্টেন মাইকেল সুয়ইনে হঠাৎ আটলান্টা থেকে বার্তা পেলেন যে ইউ এস ফেডারেল এভিয়েসন যুক্তরাষ্ট্রের সব আকাশপথ অনিবার্য কারনে বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে কোন বাণিজ্যিক বিমান যুক্তরাষ্ট্রের কোন বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবে না। বার্তা পেয়ে ফ্লাইট ফিফটিনের পাইলট ও ক্রুরা অনুমান করে নিয়েছিলেন যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে কোথায় তাই তারা ঠিক করলেন যে দ্রুত নিকটতম বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। ক্যাপ্টেন মাইকেল সুয়ইনে হিসাব করে দেখলেন যে সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর হবে কানাডার গান্ডার (Gander)। সেখানে অবতরণের জন্য কানাডিয়ান ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকদের কাছে অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুমতি পেয়ে যান।
বিমানটি গান্ডার বিমানবন্দরে অবতরণ করার আগ মুহুর্তে আটলান্টা থেকে আরো একটি বার্তা পান পাইলট। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড প্রভিন্সের গান্ডার বিমানবন্দরে ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ফিফটিন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে বারোটায় অবতরণ করে। অবতরণ করার পর পাইলট ও ক্রুরা দেখলেন ছোট এই বিমানবন্দরে আরও অনেক বিমান আসছে।
একে একে ৩৯ টি বিমান সেদিন গান্ডার বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
অবতরণ করার কিছু সময় পর নিউইয়র্কে কি ঘটেছে সেটার খবর আস্তে আস্তে বিমানের রেডিওতে আসতে শুরু করে। সন্ধ্যার দিকে জানা যায় যে, World Trade Center এ দুইটি ছিনতাইকৃত বিমান আঘাত হেনেছে আর তাতে দুটি বিল্ডিংই ধ্বসে পড়েছে। রাতে কানাডিয়ান গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে জানানো হয় তারা রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানের যাত্রীদের এক এক করে বাইরে আসার সুযোগ করে দেবে। ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটির জন্য সময় নির্ধারণ হয় পরেরদিন সকাল ১১টা। যাত্রীরা খানিকটা বিরক্ত হয়েই বিমানেই রাত্রিযাপনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। গান্ডার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ঔষধ, পানি, হাতমুখ ধোওয়া ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করে। কোনো ঝামেলা ছাড়াই রাত পার হয় যদিও কেউই ফ্লাইট ফিফটিনের উৎকণ্ঠার কারনে ঘুমাতে পারেননি।
পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কিছু স্কুলবাস গান্ডার বিমানবন্দরে এসে ঢুকে। তার মধ্যে কিছু এসে দাঁড়ায় ডেলটা এয়ারলাইনস বিমানের কাছে। যাত্রীদের নেমে আসতে বলা হয়। নেমে এলে তাদের সবাইকে বিমানবন্দর টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকল যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ সারতে হয়। পাশাপাশি রেড ক্রসের স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে নাম নিবন্ধন করতে হয়। এরপর ক্রুদের আলাদা একটি ভ্যানে করে ছোট একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জানানো হয় যে, যখন ইউ এস ফেডারেল এভিয়েসন বিমান চলাচলে অনুমতি দেবে তখন যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
ফাউন্ডল্যান্ড প্রভিন্স কর্তৃপক্ষ গান্ডার ও এর আশেপাশের ৭৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সব হাইস্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, আশ্রয়স্থল ও সভাস্থলে আটকে পরা যাত্রীদের থাকার জন্য নির্দেশ দেয়। গান্ডারে বসবাসরত দশ হাজার স্থানীয় মানুষ ৩৯ টি বিমানের প্রায় সাত হাজার যাত্রীর দেখভালের দায়িত্ব নেয়। বন্ধুসুলভ গান্ডারবাসী যাত্রীদের ডাকা শুরু করে ‘plane people’। হাইস্কুলের ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ জানানো হয়; সবাই এগিয়ে এসে ‘plane people’ দের সেবা করতে শুরু করে। ডেলটা এয়ারলাইনসয়ের ফ্লাইট ফিফটিনের ২১৮ জন যাত্রী যেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই শহরের নাম লেওইসপোর্টে (Lewisporte )। সেখানকার একটি হাইস্কুলে এই ২১৮ জন যাত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যারা পরিবার নিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে একসঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়। আর সব বয়স্ক যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয়দের বাসায়।
স্থানীয় বেকারিগুলো ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হয়। নিকটবর্তী টুইলাইনগেট (Twillingate) শহরের লোকেরা প্রতিবেলা ২০০ মানুষের খাবার – মুলত সেন্ডউইচ আর সুপ, নিয়ে আসতো ‘plane people’ দের জন্য। স্থানীয় দোকানগুলো টুটপেস্ট, ব্রাশ, সাবান আর কম্বল এনে দিত যার জন্য তারা কোন দাম রাখেনি।এছাড়া সব যাত্রীদের লন্ড্রির টোকেন দেওয়া হয়েছিল। যাত্রীদের কারো লাগেজই বিমান থেকে আনতে দেওয়া হয়নি তাই অনেকেই এক কাপড়ে ছিলেন। স্থানীয় মানুষজন ও হাইস্কুলের ছাত্ররা কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে সব ধরণের জিনিসপত্র দিয়ে বিমানের যাত্রীদের সাহায্য করেছিলো।
এভাবে কাটে চার দিন। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে, জানানো হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলো পুনরায় চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীদের সঠিক সময়ে গান্ডার বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। স্থানীয় রেড ক্রসের প্রতিনিধিদের কাছে প্রত্যেক যাত্রীদের নিবন্ধন ছিল। তারা যাত্রীদের সঠিক হিসাব রেখেছিলেন এবং জানতেন কখন কোন বিমান ছেড়ে যাবে এবং কখন কোন যাত্রীদের বিমান বন্দরে আনতে হবে। সবকিছুর সমন্বয় হয়েছিল চমৎকার ভাবে।
ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটির সব যাত্রীরা একে একে বিমানে উঠলেন। তাদের দেখে মনে হলো না তারা আটকা পরে ছিলেন এই চার দিন। বরং মনে হল সবাই প্রমোদ ভ্রমণে আছেন; সব যাত্রী আনন্দিত, হাসিখুশি; সবাই সবাইকে চেনেন। এতোই চেনেন যে নাম ধরে ডাকতে পারছেন। ফ্লাইট ফিফটিন আকাশে উড়ল আটলান্টায় পথে।
অবস্থানকালীন সময়টা কে কিভাবে উপভোগ করেছে সেটা নিয়ে গল্প জুড়ে দেন যাত্রীরা, একে অন্যকে গল্প বলে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। কার থেকে কে ভালো সময় কাটিয়েছে সেটা নিয়ে জমে উঠল আড্ডা। ফ্লাইটটি একসময় আটলান্টায় ফিরে আসল। পুরোটা সময় যাত্রীরা গল্প করছিলেন এবং ফোন নম্বর, ঠিকানা ও ই-মেইল অ্যাড্রেস আদান-প্রদান করছিলেন। হঠাৎ শারলি ব্রুকস নামের একজন যাত্রী উঠে গিয়ে ক্রুকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি কি আপনাদের পি এ সিস্টেম দিয়ে একটা ঘোষণা দিতে পারি? ক্রুরা সাধারণত এটা করতে অনুমতি দেন না কিন্তু সেদিন একজন ক্রু বললেন- অবশ্যই পারেন। শারলি ব্রুকস মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে সবাইকে আরো একবার মনে করিয়ে দিলেন গেল কয়েকটা দিন তারা কেমন কাটিয়েছেন, কি অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সে বিষয়টি। লেওইসপোর্টে শহরের স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে তারা যে আতিথিয়েতা পেয়েছে সেটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর তিনি বললেন যে ফ্রাঙ্কফুট ফিরে গিয়ে তিনি লেওইসপোর্টে শহরের স্থানীয় লোকজনের জন্য কিছু করতে চান।
শারলি ব্রুকস বললেন ডেলটা ফিফটিন নামে তিনি একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করতে চান। এই ট্রাস্ট ফান্ডের কাজ হবে লেওইসপোর্টে শহরের হাইস্কুল ও কলেজের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া। তার সহযাত্রীদের কাছ থেকে তিনি বিনীত ভাবে ডোনেশন চাইলেন। তুমুল হাততালির মাধ্যমে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালো অন্য যাত্রীরা। ডোনেশন নেয়া শুরু হলো। ডোনেশনের কাগজটিতে নাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা ও ই-মেইল অ্যাড্রেস লিখতে হলো। দেখা গেল ১৪ হাজার ডলার ডোনেশন উঠেছে। শারলি ব্রুকস প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি দ্রুত বৃত্তির জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত ওই ট্রাস্ট ফান্ডে ১.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার জমা পড়েছিল। এই ফান্ড থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেওইসপোর্টে শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ১৫৮জন ছাত্রকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে গান্ডার এর স্থানীয়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে Lufthansa তাদের একটি এয়ারবাসের নাম দেয় Gander/Halifax। আমেরিকান টিভি চ্যানেল CBC ২০০৯ এ বের করে Diverted নামে একটি সিনেমা যেখানে টুইন টাওয়ারে হামলার পরের মুহূর্ত, গান্ডার শহরের আতিথিয়েতা এবং ‘plane people’ দের সঙ্কটকালীন সময়ের উৎকণ্ঠা দেখানো হয়েছে।
শারলি ব্রুকস এখন বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন তবু বছরে অন্তত একবার তিনি লেওইসপোর্টে শহরে যান। প্রতিবারই যেয়ে দেখেন ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ফিফটিনের অন্য অনেক যাত্রীও বেড়াতে এসেছেন। একই অবস্থা গান্ডার এর অন্য শহর গুলোতেও। সেই সময়ের আটকে পড়া সাত হাজার ‘plane people’ হয়তো আজীবনের জন্য গান্ডার বাসীর আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছেন।
বিমানটি গান্ডার বিমানবন্দরে অবতরণ করার আগ মুহুর্তে আটলান্টা থেকে আরো একটি বার্তা পান পাইলট। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড প্রভিন্সের গান্ডার বিমানবন্দরে ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ফিফটিন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে বারোটায় অবতরণ করে। অবতরণ করার পর পাইলট ও ক্রুরা দেখলেন ছোট এই বিমানবন্দরে আরও অনেক বিমান আসছে।
একে একে ৩৯ টি বিমান সেদিন গান্ডার বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
অবতরণ করার কিছু সময় পর নিউইয়র্কে কি ঘটেছে সেটার খবর আস্তে আস্তে বিমানের রেডিওতে আসতে শুরু করে। সন্ধ্যার দিকে জানা যায় যে, World Trade Center এ দুইটি ছিনতাইকৃত বিমান আঘাত হেনেছে আর তাতে দুটি বিল্ডিংই ধ্বসে পড়েছে। রাতে কানাডিয়ান গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে জানানো হয় তারা রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানের যাত্রীদের এক এক করে বাইরে আসার সুযোগ করে দেবে। ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটির জন্য সময় নির্ধারণ হয় পরেরদিন সকাল ১১টা। যাত্রীরা খানিকটা বিরক্ত হয়েই বিমানেই রাত্রিযাপনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। গান্ডার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ঔষধ, পানি, হাতমুখ ধোওয়া ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করে। কোনো ঝামেলা ছাড়াই রাত পার হয় যদিও কেউই ফ্লাইট ফিফটিনের উৎকণ্ঠার কারনে ঘুমাতে পারেননি।
পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কিছু স্কুলবাস গান্ডার বিমানবন্দরে এসে ঢুকে। তার মধ্যে কিছু এসে দাঁড়ায় ডেলটা এয়ারলাইনস বিমানের কাছে। যাত্রীদের নেমে আসতে বলা হয়। নেমে এলে তাদের সবাইকে বিমানবন্দর টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকল যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ সারতে হয়। পাশাপাশি রেড ক্রসের স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে নাম নিবন্ধন করতে হয়। এরপর ক্রুদের আলাদা একটি ভ্যানে করে ছোট একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জানানো হয় যে, যখন ইউ এস ফেডারেল এভিয়েসন বিমান চলাচলে অনুমতি দেবে তখন যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
ফাউন্ডল্যান্ড প্রভিন্স কর্তৃপক্ষ গান্ডার ও এর আশেপাশের ৭৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সব হাইস্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, আশ্রয়স্থল ও সভাস্থলে আটকে পরা যাত্রীদের থাকার জন্য নির্দেশ দেয়। গান্ডারে বসবাসরত দশ হাজার স্থানীয় মানুষ ৩৯ টি বিমানের প্রায় সাত হাজার যাত্রীর দেখভালের দায়িত্ব নেয়। বন্ধুসুলভ গান্ডারবাসী যাত্রীদের ডাকা শুরু করে ‘plane people’। হাইস্কুলের ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ জানানো হয়; সবাই এগিয়ে এসে ‘plane people’ দের সেবা করতে শুরু করে। ডেলটা এয়ারলাইনসয়ের ফ্লাইট ফিফটিনের ২১৮ জন যাত্রী যেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই শহরের নাম লেওইসপোর্টে (Lewisporte )। সেখানকার একটি হাইস্কুলে এই ২১৮ জন যাত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যারা পরিবার নিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে একসঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়। আর সব বয়স্ক যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয়দের বাসায়।
স্থানীয় বেকারিগুলো ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হয়। নিকটবর্তী টুইলাইনগেট (Twillingate) শহরের লোকেরা প্রতিবেলা ২০০ মানুষের খাবার – মুলত সেন্ডউইচ আর সুপ, নিয়ে আসতো ‘plane people’ দের জন্য। স্থানীয় দোকানগুলো টুটপেস্ট, ব্রাশ, সাবান আর কম্বল এনে দিত যার জন্য তারা কোন দাম রাখেনি।এছাড়া সব যাত্রীদের লন্ড্রির টোকেন দেওয়া হয়েছিল। যাত্রীদের কারো লাগেজই বিমান থেকে আনতে দেওয়া হয়নি তাই অনেকেই এক কাপড়ে ছিলেন। স্থানীয় মানুষজন ও হাইস্কুলের ছাত্ররা কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে সব ধরণের জিনিসপত্র দিয়ে বিমানের যাত্রীদের সাহায্য করেছিলো।
এভাবে কাটে চার দিন। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে, জানানো হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলো পুনরায় চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীদের সঠিক সময়ে গান্ডার বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। স্থানীয় রেড ক্রসের প্রতিনিধিদের কাছে প্রত্যেক যাত্রীদের নিবন্ধন ছিল। তারা যাত্রীদের সঠিক হিসাব রেখেছিলেন এবং জানতেন কখন কোন বিমান ছেড়ে যাবে এবং কখন কোন যাত্রীদের বিমান বন্দরে আনতে হবে। সবকিছুর সমন্বয় হয়েছিল চমৎকার ভাবে।
ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটির সব যাত্রীরা একে একে বিমানে উঠলেন। তাদের দেখে মনে হলো না তারা আটকা পরে ছিলেন এই চার দিন। বরং মনে হল সবাই প্রমোদ ভ্রমণে আছেন; সব যাত্রী আনন্দিত, হাসিখুশি; সবাই সবাইকে চেনেন। এতোই চেনেন যে নাম ধরে ডাকতে পারছেন। ফ্লাইট ফিফটিন আকাশে উড়ল আটলান্টায় পথে।
অবস্থানকালীন সময়টা কে কিভাবে উপভোগ করেছে সেটা নিয়ে গল্প জুড়ে দেন যাত্রীরা, একে অন্যকে গল্প বলে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। কার থেকে কে ভালো সময় কাটিয়েছে সেটা নিয়ে জমে উঠল আড্ডা। ফ্লাইটটি একসময় আটলান্টায় ফিরে আসল। পুরোটা সময় যাত্রীরা গল্প করছিলেন এবং ফোন নম্বর, ঠিকানা ও ই-মেইল অ্যাড্রেস আদান-প্রদান করছিলেন। হঠাৎ শারলি ব্রুকস নামের একজন যাত্রী উঠে গিয়ে ক্রুকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি কি আপনাদের পি এ সিস্টেম দিয়ে একটা ঘোষণা দিতে পারি? ক্রুরা সাধারণত এটা করতে অনুমতি দেন না কিন্তু সেদিন একজন ক্রু বললেন- অবশ্যই পারেন। শারলি ব্রুকস মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে সবাইকে আরো একবার মনে করিয়ে দিলেন গেল কয়েকটা দিন তারা কেমন কাটিয়েছেন, কি অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সে বিষয়টি। লেওইসপোর্টে শহরের স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে তারা যে আতিথিয়েতা পেয়েছে সেটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর তিনি বললেন যে ফ্রাঙ্কফুট ফিরে গিয়ে তিনি লেওইসপোর্টে শহরের স্থানীয় লোকজনের জন্য কিছু করতে চান।
শারলি ব্রুকস বললেন ডেলটা ফিফটিন নামে তিনি একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করতে চান। এই ট্রাস্ট ফান্ডের কাজ হবে লেওইসপোর্টে শহরের হাইস্কুল ও কলেজের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া। তার সহযাত্রীদের কাছ থেকে তিনি বিনীত ভাবে ডোনেশন চাইলেন। তুমুল হাততালির মাধ্যমে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালো অন্য যাত্রীরা। ডোনেশন নেয়া শুরু হলো। ডোনেশনের কাগজটিতে নাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা ও ই-মেইল অ্যাড্রেস লিখতে হলো। দেখা গেল ১৪ হাজার ডলার ডোনেশন উঠেছে। শারলি ব্রুকস প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি দ্রুত বৃত্তির জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত ওই ট্রাস্ট ফান্ডে ১.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার জমা পড়েছিল। এই ফান্ড থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেওইসপোর্টে শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ১৫৮জন ছাত্রকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে গান্ডার এর স্থানীয়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে Lufthansa তাদের একটি এয়ারবাসের নাম দেয় Gander/Halifax। আমেরিকান টিভি চ্যানেল CBC ২০০৯ এ বের করে Diverted নামে একটি সিনেমা যেখানে টুইন টাওয়ারে হামলার পরের মুহূর্ত, গান্ডার শহরের আতিথিয়েতা এবং ‘plane people’ দের সঙ্কটকালীন সময়ের উৎকণ্ঠা দেখানো হয়েছে।
শারলি ব্রুকস এখন বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন তবু বছরে অন্তত একবার তিনি লেওইসপোর্টে শহরে যান। প্রতিবারই যেয়ে দেখেন ডেলটা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ফিফটিনের অন্য অনেক যাত্রীও বেড়াতে এসেছেন। একই অবস্থা গান্ডার এর অন্য শহর গুলোতেও। সেই সময়ের আটকে পড়া সাত হাজার ‘plane people’ হয়তো আজীবনের জন্য গান্ডার বাসীর আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছেন।
Comments