Skip to main content

প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনাই প্র্যাকটিকাল বিজ্ঞাপন

মানুষের যদি নিজের মন ও শরীরের উপর মালিকানা থাকে তাহলে সে আত্মহত্যা করবে কিনা সেটা সেই সিদ্ধান্ত নিক। যদি অন্য কেউই তাকে বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য করে, তবে মানুষটিতো তার নিজের জীবনের মালিক নয়, তার জীবন অন্যের কাছে বন্দী। আর বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেতে তো সে আত্মহত্যাকে বেছে নিতেই পারে, কারন সেতো মুক্তিই চাইছে! মুক্তি পেয়ে লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকে সে। মর্গের বাইরে প্রিয়জন ডুকরে কাঁদে।

আত্মহত্যাকারীরা হয়তো জীবন শেষ করে দিতে চায়না, শুধু চায় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ দূর করতে। যন্ত্রণাটা দূর হয় তাই এক অর্থে তারা তো সফল। তাই আত্মহত্যা হয়তো সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান। একজন দুঃখী মানুষ যখন কোন উপায় খুঁজে পায় না যন্ত্রণা থেকে পরিত্রানের, যখন অত্যাচারের প্রতিকার পাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না, যখন ভবিষ্যৎ অন্ধকার; তখন দুঃখের ইতি ঘটাবার উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে সে যন্ত্রণা, দুঃখ, দুর্ভোগ থেকে পরিত্রান পায়। জীবিত মানুষেরা, যারা সেই যন্ত্রণার মাত্রা আনুধাবন করতে পারে না তারা কীভাবে বিশ্লেষণ করবে কাজ তা ভালো হয়েছে না খারাপ!

জাপানে সামুরাই যোদ্ধারা একসময় নিজের পেট কেটে আত্মহত্যা করতো অপমান ও ব্যক্তিগত পরাজয়ের যাতনা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য; একে সাহসী ও সঠিক কাজ বলেই গণ্য করা হতো সে সময়। আবার ডিউটিফুল সুইসাইডের concept প্রচলন ছিল অনেক পশ্চিমা সমাজে; যেখানে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা অসম্মানিত হওয়া থেকে নিজেদের ও নিজেদের পরিবারকে বাচাতে আত্মহত্যা করতেন। এর উদাহরন গ্রিক সম্রাট নিরো ও জার্মান জেনারেল এরউইন রোমেল। আত্মহত্যার পেছনে জিনগত ভিত্তিও আছে; পরিবারের কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যা করলে তার সন্তানদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করার আশঙ্কা বেশি থাকে। আবার একই ডিম্বাণু থেকে জন্মানো যমজদের একজন আত্মহত্যা করলে আরেকজনও আত্মহত্যা করার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

মানব প্রজাতি অনুকরণপ্রিয় তাই প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা একরকম বিজ্ঞাপন; বেশ প্র্যাকটিকাল বিজ্ঞাপন। বিখ্যাত মানুষ যদি আত্মহত্যা করে তবে বিজ্ঞাপনের সফলতার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। গ্রাঞ্জ রক আইকন কার্ট কোবেনের আত্মহত্যার পর পৃথিবী জুড়ে অনেক মিউজিসিয়ান যন্ত্রণা থেকে চীরমুক্তি পাবার উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে বিবেচনা করেছেন। মেরিলিন মনরো যে বছর আত্মহত্যা করেন সেই বছর পুরো আমেরিকায় আত্মহননের সংখ্যা ১২% বেড়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড ফিলিপ্স ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যখন কোন আত্মহত্যার খবর ছাপা হয়েছে, সেই এলাকার ডাটা জোগাড় করে দেখেছেন ঐ এলাকায় তৎক্ষণাৎ আত্মহননের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে। এরপর ফিলিপ্স আত্মহত্যার সাথে ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন, কারণ অনেক মানুষই ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করে আত্মহত্যা করে। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস এবং সান ফ্র্যান্সিসকো ক্রনিকলসে প্রকাশিত ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের ডাটা খেয়াল করে ফিলিপ্স দেখেন যে আলোচিত কোন আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হবার পরদিন ট্র্যাফিক এক্সিডেন্ট স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায় ৫.৯%, দুই দিন পর ৪.১%, তিনদিন পর ৩.১%, চারদিন পর ৮.১% এবং দশদিন পর সংখ্যা আবার নরমাল অবস্থায় পৌঁছে যায়। ডেভিড ফিলিপ্স আরও লক্ষ্য করেন যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত আত্মহননের ঘটনা যদি কোন তরুণ করে, তাহলে এই ট্র্যাফিক এক্সিডেন্টের মাধ্যমে আত্মহত্যাও করে তরুণ-তরুণীরা, প্রকাশিত খবর কোন বৃদ্ধকে নিয়ে হলে এক্সিডেন্টের ডাটাতেও দেখা যায় বুড়োদের আধিপত্য।

গ্রাঞ্জ রক মিউজিশিয়ান কার্ট কোবেইনের মৃতদেহ ১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল তার লেক ওয়াশিংটনের বাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয়। সেদিন সকালে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি গ্যারি স্মিথ বাড়ীতে ঢুকে কোবেইনকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পান। গ্যারি প্রথমে ভেবেছিলেন, ঘুমিয়ে আছেন কোবেইন; কিন্তু কাছে যেয়ে খেয়াল করেন, কোবেইনের থুতনির কাছে একটি শটগান তাক করা আছে। পুলিশকে খবর দেন তিনি। পুলিশ আসে এবং নিশ্চিত করে কার্ট কোবেইন মৃত। পোস্টমর্টেম করা হয়, রিপোর্টে বলা হয় মৃতদেহ উদ্ধারের তিনদিন আগে নিজের মাথায় শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন কার্ট কোবেইন। রক্তে অস্তিত্ব পাওয়া যায় মাত্রাতিরিক্ত হেরোইন ও ডায়াজিপাম। মৃতদেহের পাশে একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল; শৈশবের বন্ধু বুদ্ধাকে ( Boddah ) উদ্দেশ্য করে কোবেইন সেখানে লিখেছিলেন - ‘সংগীত সৃষ্টি বা শোনার সময় আগে যে টানটান উত্তেজনা অনুভব করতাম, অনেক দিন থেকে তা আর পাচ্ছি না। এমনকি লেখার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছি আমি। বছরের পর বছর ধরে শূন্যতার অনুভূতি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।’ বুদ্ধা বাস্তবিক কোনো চরিত্র ছিল না; সে ছিল কোবেইনের কাল্পনিক বন্ধু। চিরকুটে কার্ট কোবেইন লেখেন - ‘আমি আদতে এক লক্ষ্যভ্রষ্ট বিষণ্ণ শিশু।’ লক্ষ্যভ্রষ্ট বিষণ্ণ শিশুর সামনে আশা থাকে না, আলো থাকে না, ভবিষ্যৎ থাকে না তাই হয়তো ইচ্ছামৃত্যুকেই তিনি শ্রেয় মনে করেছিলেন। চিরকুটের শেষের দিকে এসে কার্ট কোবেইন লেখেন – ‘ফ্যাকাশে হয়ে যাবার চেয়ে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া উত্তম।’ চিরকুটের শেষ করেন উল্টো কথায়; লেখেন - 'শান্তি, ভালোবাসা, সহানুভূতি।’ হতে পারে ইচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শান্তি, ভালোবাসা, সহানুভূতি।

চেস্টার বেনিংটন মারিজুয়ানা, অপিয়াম, কোকেইন ও মেটাফেটামিনে আসক্ত হন কৈশোরবেলায় তার বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হবার পর। স্কুলে পড়ার সময় দুর্বল শরীরের কারণে চেস্টার সহপাঠিদের হাতে মার খেতেন, সেক্সুয়ালি এবিউসড হতেন। এসব থেকে বাচবার উপায় হিসেবে তিনি ছবি আকা শুরু করেন, গান লেখা শুরু করেন। লিংকিন পার্ক ব্যান্ডের হয়ে গান গাইবার সময় উগড়ে দিতেন সেই দুঃসময়ের আর্তনাদ। এই চেস্টার বেনিংটন লস অ্যাঞ্জেলেসে তার নিজ বাসভবনে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন সম্প্রতি। আত্মহননের জন্য বেছে নেন তার বন্ধু, আরেক মিউজিসিয়ান ক্রিস কর্নেলের জন্মদিন। ক্রিস কর্নেলও গত মে মাসে আত্মহত্যা করেন। চেস্টার বেনিংটন  তার ‘In the end’ এ লিখেছিলেনঃ
I tried so hard and got so far
But in the end, it doesn’t even matter
I had to fall to lose it all
But in the end, it doesn’t even matter.

চেস্টার বেনিংটন ও ক্রিস কর্নেলের আত্মহনন আসলে বড় ব্যানারের বিজ্ঞাপন। ইচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা বেড়ে যাবে শ্রোতাদের মাঝে। আমাদের দেশেও চেস্টার বেনিংটন ও ক্রিস কর্নেলের ভক্ত কম নয়, বিষণ্ণতা, মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্ত, উদ্বেগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যাও কম নয়। এই দুইয়ের সংমিশ্রণ এক সাগরে মিশে; আত্মহননের সাগরে। তবে আত্মহত্যা করাটা সহজ নয়। সহজ নয় বলেই সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না; গলায় ফাস দেবার পরও তার সমস্ত শরীর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেস্টা করে। এজন্য নিজের হাত দিয়ে নাক মুখ চেপে শ্বাস বন্ধ করে আত্মহত্যা করা সম্ভব হয় না। যে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে সেও শেষ মুহুর্তে দাপাদাপি করে বেঁচে থাকার চেস্টায়। বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেস্টা করা মানুষও শেষ মুহুর্তে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার আপ্রাণ সংগ্রাম করে। সেদিক থেকে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা বেশ কার্যকরি কিন্তু পিস্তল যোগাড় করাও সহজ নয়।

তবে কি হবে পিস্তল যোগাড় করতে পারলে বা না পারলে; ইন দ্যা এন্ড, ইট ডাজন’ট ইভেন ম্যাটার!

Comments

Popular posts from this blog

Dhaka in the 1950s and 1960s

In the mid 1950s, Dhaka, known as ‘Dacca’ at that time, was just a small provincial town with about 3,00,000 inhabitants. Dhanmondi at that time just started to grow; Maulvi Abdus Sobhan's family had some habitation in Sobhanbagh, Dhaka Stadium was being constructed to host cricket matches and New Market was starting to become a busy shopping area. Dhaka residents loved cinema since the time it was introduced. Baliadi Siddiki family owned Nishat Cinema Hall and held a mega event when the film ‘Aan’ by Mehboob Khan was released in 1952. Elephants were used by the hall owner to distribute leaflets and to spray colour water. There was another prominent hall named Britannia near Rex Restaurant at Gulistan but was closed down in the late 1950s. Gulistan Cinema Hall, city’s first modernity landmark, came up in 1952. Amber, started with Raj Kapoor and Nargis, was the first film the hall showed. Mukul which later became 'Azad 'used to show Bengali films from Kolkat

সুন্দর পশু-পাখি, সুন্দর গাছ আর সুন্দর সুন্দর জঙ্গল নিয়ে সুন্দরবন

...প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এদেশের মানুষের পক্ষ হয়ে বর্ম হিসেবে দাড়িয়ে যাওয়া সুন্দরবনের সাথে বেশীর ভাগ মানুষের প্রথম পরিচয় হয় বাংলা ১ম পত্রের গদ্য বইয়ে অথবা বাংলা ২য় পত্রের রচনায়। সুন্দরবন - এর আক্ষরিক অর্থ 'সুন্দর জঙ্গল' অথবা 'সুন্দর বনভূমি' কিন্তু নামকরণ হয়েছিল 'সুন্দরী গাছ' থেকে যা এখানে প্রচুর পরিমানে জন্মে। তবে যেহেতু স্থানীয় আদিবাসীরা অনেক আগে থেকে বনটিকে ‘চন্দ্র-বান্ধে’ নামে ডাকতো তাই হতে পারে ‘চন্দ্র-বান্ধে’ নামটি কালের পরিক্রমায় ‘সুন্দরবন’ হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে অবস্থিত এই বনের বাঘ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নামে পরিচিত যদিও সংখ্যায় এখন এ প্রাণী ক্রমনিম্নগামী। সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত হবার কারনে এখানকার পানি নোনতা এবং এই লবণাক্ততার কারণে বাঘ অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকে যা তাদের বেশ আগ্রাসী করে তোলে তাই  মাছ ও মধু সংগ্রহকারী মানুষদের উপর সুযোগ পেলে তারা ঝাপিয়ে পরে। ১৭৫৭ সালে পুরো বাংলার ইজারা নেয় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যার মধ্যে সুন্দরবনও ছিল। এই বনের গুরুত্ব বুঝতে পেরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা মানচিত্র তৈরি করে সেইসময়

Comparing current Dhaka with its past

...In late 1950s, the Adamjee group of Industries, which was one of the most significant companies in the country of that time, built an extremely modern air conditioned office-complex in Motijheel - Dilkusha area and named it Adamji Court Building. It was the first building in the city with a lift installed. The US government rented a floor in the building and housed their consular office. Hotel Purbani, located at 1 Dilkusha Commercial Area, was build in 1964 and became the most prominent hotel of that time. S.A.Sobhan, the then Additional Chief Secretary of the government and a silent advisor of Awami League in the later years, initiated the venture. Shortly A Sattar, owner of a 7-up bottling factory, joined the project. Name of the hotel was given by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman as owners were quite close to him. Elites of  the city and foreigners found the hotel a good place to be. The buffet lunch at one of the restaurants of the hotel were offered at Rs. (Pakista