...কিছুক্ষণ
চললো দমকা হাওয়া আর বিদ্যুতের ঝলকানি, এরপর
শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। চিটাগাং সার্কিট হাউস ভিজল শীতল জলে। প্রেসিডেণ্ট জিয়াউর
রহমান ও তার সফর সঙ্গীরা ঘুমিয়ে আছেন। ভ্রমনক্লান্তি,
অনবরত মিটিং, চিটাগাং ক্লাব থেকে আসা সুস্বাদ্য রাতের খাবার এবং বৃষ্টির শব্দ হয়তো
তাদের ঘুম গাড় করে দিয়েছে। প্রেসিডেণ্ট ঘুমতে
যাবার আগে নির্দেশ দিয়েছেন সকাল পৌঁনে সাতটায় যেন তাকে সকালের চা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু
ঘড়ির অ্যালার্ম বা বেয়ারার ডাক শোনার আর সৌভাগ্য
হয়নি প্রেসিডেণ্টের। রাত সাড়ে চারটায় তার ঘুম ভাঙ্গে রকেট লাঞ্চারের আওয়াজে।
সারা
চিটাগাং শহর যখন ভিজছিল বৃষ্টিতে, প্রেসিডেণ্ট যখন ঘুমচ্ছিলেন নির্বিঘ্নে, সার্কিট
হাউসে নিয়োজিত গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা যখন পায়চারী করছিলো ধীরগতীতে, পুলিশ সদস্যরা
যখন নিস্তেজ ভাবে শিফট পরিবর্তনের অপেক্ষা করছিলো, তখন ১৬ জন আর্মি অফিসারের একটা দল চিটাগাং সেনানিবাস থেকে একটা সাদা টয়োটা গাড়ি আর দুটো আর্মি পিকআপে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে সার্কিট হাউসের
দিকে এগিয়ে যায়। দলের অপেক্ষাকৃত তরুন সদস্য লেফটেন্যান্ট রফিক পিকআপে বসে কাপা গলায়
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজলেকে জিজ্ঞেস করে ‘স্যার, আর উই গোয়িং টু কিল দ্যা প্রেসিডেন্ট?’ ফজলে তাকে আশ্বস্ত
করে বলেন ‘না রফিক, আমরা শুধু তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’
হামলা
শুরু হয় রকেট লাঞ্চারের গোলা দিয়ে। একটা গোলা আঘাত হানে সার্কিট হাউসের ছাদে। অন্যটা
মুল দরজা ভেদ করে যেয়ে পড়ে অভ্যর্থনা হলের কাছে। পুলিশ ও প্রেসিডেন্ট'স গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা এই আচমকা হামলা সামাল দিতে
পারে না। গুলি ছুড়তে ছুড়তে হামলাকারী অফিসাররা উঠে আসে সার্কিট হাউসের দোতালায়। লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মতিউর রহমান অপ্রকৃতিস্থের মতন চিৎকার করতে থাকেন ‘প্রেসিডেন্ট কোথায়, প্রেসিডেন্ট
কোথায়’ বলে। উনি মাতাল কিনা বোঝা যায়
না তবে মাতাল হয়ে অফিসিয়াল প্রোগ্রামে যাবার অভ্যাস তার আছে, জানে তরুন অফিসাররা।
হামলাকারী
অফিসাররা এক একজন এক এক ঘরে হানা দেয়। ৯ নম্বর ঘরের দরজা ভেঙ্গে দুই জন অফিসার ঢুকে পড়লে সেখানে পাওয়া যায়
প্রেসিডেন্টের সফর সঙ্গী ড. আমিনাকে। ক্যাপ্টেন মোসলেহ ৪ নাম্বার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। উষ্কখুষ্ক চুলে,
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত, বিস্মিত প্রেসিডেণ্ট
দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। সদ্য ঘুম থেকে
উঠার পরও প্রেসিডেণ্টের ঠাওড় করতে দেরী হয়না যে তার সামনে অস্ত্র হাতে দাড়ীয়ে আছে পরিচিত
কয়েকটি মুখ। কিন্তু আর্মির পোশাক পরিহিত পরিচিত মুখগুলো তাকে স্বস্তি দেয়না কারণ তিনি
জানেন এদের সার্কিট হাউসে আসার কারণ তার জন্য শুভকর হতে পারে না। প্রেসিডেণ্ট স্বভাবসুলভ
দাম্ভিকতায় প্রশ্ন করেন ‘কি ব্যাপার?’ সামনে থাকা ক্যাপ্টেন মোসলেহ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন
"স্যার, আপনি ঘাবড়াবেন না।" এই ক্যাপ্টেন তখনো বিশ্বাস করেন যে তারা প্রেসিডেণ্টকে তুলে নিয়ে যেয়ে দাবী দাওয়া আদায় করবে।
ক্যাপ্টেন মোসলেহর কথা শেষ হবার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন পেছনে থাকা লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মতিউর রহমান। প্রেসিডেণ্ট ঘাবড়াবেন কি ঘাবড়াবেন না বিচার করার পর্যাপ্ত সময়
পান না কারন ক্যাপ্টেন মোসলেহর আশ্বাসের বাণী তার করোটিতে ঢোকার সেকেন্ড পাঁচ ছয় পরই
শরীরের উপরিভাগে ঢোকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমানের এসএমজি থেকে বেড়িয়ে আসা তিরিশটির
মতো গুলি। মুখ ও শরীরের ডান পাশ ঝাজরা হয়ে যায় প্রেসিডেণ্টের। দরজার কাছেই মুখ-থুবড়ে
লুটিয়ে পড়েন পূর্ববর্তী ২২ টি সামরিক ক্যু সামাল দেয়া জিয়াউর রহমান। চট্রগ্রামে বিএনপির উপদলীয় কোন্দল মিটাতে এসে তিনি জাতীয় কোন্দল মিটিয়ে দেন ৩০ মে ১৯৮১ সালের
ভোরে।
হামলাকারী
অফিসারেরা যতটা দ্রুততার সাথে এসেছিল, তার থেকেও দ্রুততার সাথে সার্কিট হাউস ত্যাগ
করে। যখন তারা আসছিলো সেনানিবাস থেকে সার্কিট হাউসে, তখন ১৬ জনের এই দলের বেশীরভাগ
অফিসার জানতো প্রেসিডেণ্টকে তারা তুলে নিয়ে আসবে। তারা জানতো প্রেসিডেণ্টকে জিম্মি
করে দাবী দাওয়া আদায় করা হবে। এই ১৬ জনই মুক্তিযোদ্ধা। এরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে
ভালোবাসলেও ভালো ভাবেই জানে প্রেসিডেন্টের কিছু কিছু পদক্ষেপ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপন্থী।
এরা কেউ মেনে নিতে পারেনি যে প্রেসিডেন্ট স্রেফ ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধী
শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করেছেন, মন্ত্রী পরিষদে এনেছেন স্বীকৃত রাজাকারদের,
পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া রাজাকার গোলাম আযমকে অসুস্থ মা দেখার অজুহাতে বাংলাদেশে প্রবেশ
করতে দিয়েছেন, সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তন করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ
করে দিয়েছেন, পাকিস্তানের আশীর্বাদপুষ্ট জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত
করেছেন এবং অ-মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বড় বড়
পদে বসিয়েছেন। প্রেসিডেন্টকে জিম্মি করে এসব অন্যায়ের প্রতিকার করা যাবে অনায়াসে, এ
বিশ্বাস ছিল দলের বেশীরভাগ তরুন অফিসারের। সার্কিট হাউস থেকে সেনানিবাস যাবার পথে এরা
হতভম্ব হয়ে ভাবে পরিকল্পনা মাফিক জিম্মি করা হলো না কেন? তাহলে কি পরিকল্পনার আড়ালে
অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল? দলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পাঁচজন। কে নেড়েছেন মুল কলকাঠি?
জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের আপন ভাগনা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব? লেফটেন্যান্ট
কর্নেল মাহবুবের কথাবার্তায় প্রকাশ পেত যে তিনি প্রেসিডেন্ট ও আর্মি চীফের উপর বিরক্ত।
নাকি কলকাঠি নেড়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান? বেপরোয়া মতিউর রহমান কারো ধার ধারেন না। তরুন অফিসাররা
দেখেছে জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের সামনেও মতিউর রহমান কেমন সটাং সটাং কথা বলেন।
জিওসি মনে করেন আর্মি চীফ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটা দুর্নীতিবাজ, লম্পট। বেপরোয়া
মতিউর রহমানের সেই চীফের সাথে বেশ সখ্য ছিল, তিনি চীফের অধিনায়কত্বে তৃতীয় বেঙ্গলে
একসময় চাকরি করেছেন। পিকআপের পেছনে বসা ক্যাপ্টেন মোসলেহর মনে পরে মাত্র চারদিন আগে
আর্মি চীফ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ চিটাগাং সফরে এসেছিলেন এবং একান্তে মতিউর রহমানের সাথে অফিসার্স মেসে দুপুরের
খাবার খেয়েছিলেন। এই লোককে জিওসি কেন কাছে কাছে রাখেন মাথায় আসে না এই ক্যাপ্টেনের।
সার্কিট
হাউস ততক্ষণে শান্ত। সব সুনসান। ধীরে ধীরে প্রেসিডেণ্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী বিএনপি
নেতারা যার যার রুম থেকে বেড়িয়ে আসেন। তারা ঠাওড় করতে পারেন না প্রেসিডেন্টের লাশ দেখে
বিচলিত হবেন নাকি নিজেরা বেচে আছেন বলে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করবেন। নেতার লাশ
রেখে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে হয় তাদের কাছে। একে একে তারা বেড়িয়ে যান সার্কিট হাউস
থেকে। এর পর একে একে বেড়িয়ে যান ঢাকা থেকে প্রেসিডেন্টের সাথে আসা তিনজন আর্মি অফিসারও।
গার্ড রেজিমেন্টের একজন হতবিহব্বল সৈনিক থেকে যায় প্রেসিডেন্টের লাশ পাহারায়। ততক্ষণে মেঝেতে থাকা রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বাধতে
শুরু করেছে। সার্কিট হাউসে অবস্থানকারী এই একজনের বিশ্বস্ততাই হয়তো প্রশ্নাতীত।
সেইদিন
ভোর সকালে একদল আর্মি অফিসার বাংলাদেশ বেতারের চিটাগাং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন নেয়। কর্মরত
ব্যক্তিকে বলে কাগজ কলম আনতে। বেতারে তখন চলছে দেশাত্ববোধক গান –সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও
তুমি। কাগজ কলম সামনে আসলে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিখতে শুরু করলেন ঘোষণা ‘প্রিয় দেশবাসী...’। ততক্ষণে নতুন গান শুরু হয়ে
গেছে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ;
জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’ যে গান মৃত প্রেসিডেণ্টের
খুব প্রিয় জানেন উপস্থিত আর্মি অফিসারেরা। এক মেজর বলে উঠলেন ‘বন্ধ করো এই গান’। তখনো শাহনাজ রহমতুল্লাহ গাইছেন
...আমার আঙ্গিনায়, ছড়ান বিছানো সোনা সোনা ধূলিকণা; মাটির মমতায় ঘাস ফসলে সবুজের আল্পনা। জবুথবু বেতার কর্মচারী তাড়াতাড়ি গান বন্ধ করে জানতে
চাইলো কোনটা বাজাবে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল বললেন ‘যে কোন একটা বাজাও; এইটা আগে বন্ধ করো’। বেতার কর্মচারী চালিয়ে দিলো
খুরশিদ আলমের গাওয়া চটুল গান -চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে? এই নিরীহ বেতার কর্মচারীর তো জানা নেই ঘণ্টা তিন
আগে প্রেসিডেণ্ট জিয়াউর রহমানের পথ শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি ও বোধের সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে
জমাটবদ্ধ অন্ধকারে; একা এক পথে।
তথ্য সূত্রঃ
১। বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৫-৮১)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন, পালক পাবলিশার্স
২। তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা
লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ, মোহনা প্রকাশনী
৩।রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি
জায়েদুল আহসান, চর্চা প্রকাশন
৪।বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভল্যুশন, হিরোশিমা'জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?
লরেন্স লিফশুলৎজ
৫।এক জেনারেলের নীরব স্বাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক
মেজর জেনারেল (অব.) মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম; মাওলা ব্রাদার্স
৬।Bangladesh: A
Legacy of Blood
Anthony
Mascarenhas, Hodder and Stoughton
৭।দ্বিতীয় খুনের কাহিনী
মসিউল আলম, প্রথমা প্রকাশনী
৮। জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকান্ড- এবং
তারপর
এএসএম সামসুল আরেফিন
৯।স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর
কামরুদ্দীন আহমদ, নওরোজ কিতাবিস্তান
Comments