রিক্সায় চড়া, বাসে চড়া ওয়াফিকের পছন্দ না। ছোট ছিল যখন ওকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠলে বিরক্ত হতো। আমি আমল দিতাম না। এখন সে বড় হয়েছে, আগামী মাসে ১০ বছর পূর্ণ হবে। গত পরশুদিন দুপুরে বাইরে খেতে যাবার
কথা। আসমা অফিস থেকে আসবে, আমি আর ওয়াফিক বাসা থেকে যাব; একটা রেস্টুরেন্টে মিলিত করার কথা। আমি ওয়াফিককে বললাম - রাস্তায় জ্যাম থাকে; চলো রিক্সায় যাই। ও বলল- না, গাড়ীতেই যাব। আমি বোঝাতে গেলে যে রিক্সায় গেলেই তাড়াতাড়ি পৌছাবো, সে মুখের উপর বলে বসলো - রিক্সায় গেলে আমি যাব না, তুমি একা যাও।
আমি একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম। আকস্মিক রিয়েকশনে বললাম – That’s your decision boy, থাকো বাসায়। ওকে রেখে চলে গেলাম। সময়টা তিতা হয়ে গেলো। তাহলে কি রিক্সা চড়া বা বাসে চড়া মানুষগুলোকে ওয়াফিক একটু হলেও ‘অন্য স্তরের’ বলে মনে করে? তাহলে কি ওর কাছে গাড়ীতে চড়া, আইফোন ব্যবহার করা, YouTube এ ভিডিও আপলোড করা আর ডিওএইচএস পার্কে সাইকেল চালানোই মানুষ মাপার স্ট্যান্ডার্ড?
আমি নিয়মিত পাবলিক বাসে চড়ি, রিক্সায় চড়ি। আসমা অফিস থেকে নিয়মিত বাসায় আসে রিক্সা করে। ওয়াফিক এটা ভালো করেই জানে। তাহলে ও এরকম মনোভাব পোষন করবে কেন? সন্তান যদি এই মনে করে বড় হয় যে রিক্সায় চড়া, বাসে চড়া মানুষগুলো তার থেকে ‘অন্য স্তরের’ তাহলে আমি এবং আসমা বাবা-মা হিসেবে বেশ ভালো
ভাবেই ব্যর্থ।
আমি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আমার দাদার নিজের গাড়ী ছিল; বাবার ছিল, এখন সংখ্যা বেড়েছে; আমার মা নিজের গাড়ী নিজে চালান; আমারও একটা আছে। ধনী আলেসান কোটিপতি পরিবার আমরা নই তবে যেকোন মানদন্ডে আমি থার্ড জেনারেশন উচ্চ-মধ্যবিত্ত। সেই ধারাবাহিকতায় ওয়াফিক ফোর্থ জেনারেশন উচ্চ-মধ্যবিত্ত।
বাংলাদেশী উচ্চমধ্যবিত্তের কিছু ‘গরম ভাব’ আছে আর আছে ‘আলগা’ অহংকার। এরা পোশাক-আশাক ও চেহারাকেই সবকিছুর মানদন্ড হিসেবে দেখে। এখন যোগ হয়েছে কে কতো লেটেস্ট গাড়ি ও ফোন ব্যবহার করে তার উপর মানুষকে বিচার করা। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিন্তু তা মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়ে নয়, অন্য মানুষকে ছোট করার বিনিময়ে নয়।
আমার পরিবারের
ভেতর এবং আসেপাশে আমি অনেক উচ্চ-মধ্যবিত্ত দেখেছি; নতুন মডেলের ফোন, গাড়ী, ফুলে উঠা ব্যাংক একাউন্ট, উঠতে বসতে সালাম এদেরকে উপরে তোলার পরিবর্তে ক্রমশ নীচে টেনে এনেছে। ‘মুই কি হনূরে’ ভাব নিয়ে আর মানুষকে মানুষ না মনে করার মধ্যে এরা তৃপ্তি খুজতে গিয়ে নিজেরা ‘সুখের কাঙ্গাল’ হয়ে যায়। সুখ অধরাই থাকে।
আমি আমার অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধিকে গ্র্যান্টটেড ভাবিনা। আসমাও তাই। আমরা জানি এক ঝটকায়, একটা কোন বড় এক্সিডেন্টে, একটা বড় রোগে আমরা নেমে যেতে পারি সেই রিক্সা চড়া, বাস চড়া লোকটার কাতারে যাকে ওয়াফিক এখন মনে করে ‘অন্য স্তরের’। এই উন্নাসিক / snobbish আচরন তখন ওকে কোথায় নিয়ে দাড় করাবে!
Materialistic society তে স্বাভাবিক ভাবেই আকর্ষণীয় পণ্য
পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকবে। Materialistic society প্রবলভাবে অর্থবান
হবার মন্ত্রণা দেয়। এটাই হবার কথা, ঠিকই আছে। কিন্তু তা অহংকারী snob (যে ব্যক্তি নিম্নতর সামাজিক / অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষদের অবজ্ঞার
চোখে দেখে) হবার বিনিময়ে না। আমি দেখেছে এরকম মানুষ পরবর্তী জীবনে কীরকম অতৃপ্তিতে
ভোগে irrespective of তার অর্থনৈতিক বা সামাজিক সাফল্য। আমিতো চাইনা ওয়াফিক এধরনের মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক। আমি চাই ওয়াফিক নিরহংকারী হোক। আমি চাই সে ইতিবাচক চিন্তাশীল হোক। আমি চাই সে মানিয়ে চলতে শিখুক সব
পরিস্থিতিতে। আমি চাই সে মানুষকে বিচার করুক হিউম্যান কোয়ালিটি দিয়ে, মনুষ্যত্ব দিয়ে,প্রতিভা দিয়ে। আমার ক্ষীণ একটা আশা আছে ওয়াফিক যখন পূর্ণবয়স্ক হবে তখন আমার লেখাগুলো পড়বে। এই লেখাটা পড়ে ও এটুকু বুঝে নিতে পারবে আমি বাবা হিসেবে ওকে কিভাবে ‘মানুষ’ করতে চেয়েছি। কতটুক সফল
হয়েছি তাতো ও নিজেকেই তখন যাচাই করলে বুঝতে পারবে।
Comments