১৯৩৯ সালে জার্মান আগ্রসনের সময় অস্কার শিন্ডলার পোল্যান্ডের ক্রাকোও শহরে আসেন। জাতিগত বিচারে তিনি ছিলেন এথনিক জার্মান। তখন পর্যন্ত শিন্ডলার একজন চতুর ও সুবিধাবাদী কিন্তু মধ্যম মানের ব্যবসায়ী। তিনি যুদ্ধকে তার সফলতার চাবি হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। ব্যবসার মূলধন জোগাড় করার জন্য শিন্ডলার শহরের বিত্তশালী ইহুদি পরিবারগুলোকে লুকাতে বা পালাতে সাহায্য করতে শুরু করেন। ক্রাকোও শহরে তখন নাৎসিরা বেশ কয়টি বন্দীশালা তৈরি করেছিলো যেখানে রাখা হতো ইহুদিদের। এসব বন্দীশালাকে বলা হতো ঘেট্রো। সেখানে কোনো খাবার ছিল না, পানি ছিল না, ছিল শুধু হিটলারের বাহিনীর নির্মম অত্যাচার।এখানে অল্পদিনেই বেশির ভাগ মানুষই মারা যেত। যারা বেচে থাকত তাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে গুলি করে হত্যা করা হতো। নাৎসি বাহিনীর হাতে বৃদ্ধ, শিশু, নারী, কারোর নিস্তার ছিল না। তাই অস্কার শিন্ডলারকে বিশ্বাস করা ছাড়া ইহুদি পরিবারগুলোর আর কোন অল্টারনেট ছিল না।
ইহুদি পরিবারগুলোকে লুকাতে সাহায্য করে করে এক সময় তার মূলধন জোগাড় হয়ে গেলো। তা দিয়ে শিন্ডলার ঘেট্রোর কাছে অবস্থিত দুটি কোম্পানি কিনে নেন পালিয়ে যাওয়া ইহুদিদের থেকেই। পাকা ব্যবসায়ীর মতন এবার তিনি খুজতে থাকলেন সস্তা শ্রম। বন্দী ইহুদিদের টার্গেট করলেন শিন্ডলার। তিনি নাৎসি পার্টির হর্তাকর্তাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন, যে পরিমাণ ইহুদিরা আটক আছে তাদেরকে যদি তার কারখানায় বাধ্যতামূলক শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। তিনি নাৎসি পার্টিকে এও বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি একটি তালিকা তৈরি করেছেন যেখানে সবাই দক্ষ শ্রমিক। নাৎসি পার্টি রাজি হলো।
অস্কার শিন্ডলার পেলেন সস্তা শ্রম আর বন্দীরা পেলো মরণের হাত থেকে রক্ষা। বাধ্যতামূলক শ্রমিকের পেছনে খরচ কম, লাভ বেশি। এই সস্তা শ্রম ব্যবহার করে তার ভাগ্য রাতারাতি বদলে গেল; মধ্যম মানের ব্যবসায়ী ধেকে তিনি এলিট ক্লাবে চলে গেলেন। 'উঁচুতলায়' অবাধ যাতায়াত শুরু হলো। ধীরে ধীরে অস্কার শিন্ডলার তার শ্রমিকদের খুব ঘনিষ্ট হয়ে যান এবং তাদেরকে তার পরিবার হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। কারখানায় কাজ করা ইহুদি শ্রমিকদের ভালো মানের খাবার, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন শিন্ডলার। তিনি লোকাল নাৎসিদের টাকা পয়সা দেওয়ার পাশাপাশি ঘুষও দিতেন, যাতে তার কারখানায় কাজ করা ইহুদিরা ভালো খাবার পায়, ভালো চিকিৎসা সেবা পায়।
নিজে নাৎসি পার্টির সদস্য হলেও জার্মান আর্মির নিস্রংসতা তাকে পীড়িত করতো। চতুর ও সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীর ভূমিকা থেকে তিনি হয়ে গেলেন শ্রমিক ও র্কমচারীদের রক্ষক। একসময় তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে খাটিয়ে নিজের শ্রমিক ও র্কমচারীদের আগলে রাখাতেই নিজেকে নিয়োগ করলেন। তার কারখানার ১ হাজার ২০০ জন ইহুদীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যাবার থেকে বিরত লাগলেন যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত। ব্যবসা লাটে উঠলো কিন্তু বেচে গেলো ১ হাজার ২০০ প্রান।
সেই সময়ে অস্কার শিন্ডলারের তত্ত্বাবধানে বেচে যাওয়া একজন বন্ধী পরে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই অনুভব করছিলাম যে অস্কার শিন্ডলার ছিলেন আমাদের বাবা, তিনি ছিলেন আমাদের মা, ছিলেন আমাদের একমাত্র বিশ্বাস ও ভরসাস্থল।
অস্কার শিন্ডলার ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কখনোই 'মোস্ট ফ্রিকুয়েন্টলি আস্কড' প্রশ্নের উত্তর দেননি। প্রশ্নটি হলো- তিনি এই ১ হাজার ২০০ জন ইহুদীদের বাঁচাতে বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক সেই সময় কেন নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন?
Comments