তদন্তকারীরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত যে জার্মানউইংস এয়ারলাইনারের
কো-পাইলট আনদ্রিয়াস লুবিত্জ ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রান্সের আল্পস পর্বতে বিমানটি বিধ্বস্ত
করেছে। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং দ্বারা প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে অটোপাইলট সুইচটি
আনদ্রিয়াস লুবিত্জ সর্বনিম্ন পর্যায়ে ( মাত্র ১০০ ফুট ) নির্ধারন করে রেখেছিল যাতে
কোন ক্রমেই বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়া থেকে বেচে না যায়। তার আগে সে তার ক্যাপ্টেন কে ককপিটে
ঢুকতে দেয়নি। দরজা বন্ধ দেখে ক্যাপ্টেন বিমানের ইন্টারফোন দিয়ে আনদ্রিয়াস লুবিত্জকে
দরজা খুলতে বলেন, সাড়া না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। ক্যাপ্টেন শেষ পর্যন্ত দরজা খোলার চেস্টা করতে থাকেন।
কিন্তু পারেন না। একসময় বিমানটি সাতশো কিলোমিটার বেগে পর্বতের গায়ে আছড়ে পরে। সবশেষ হয়ে যায়।
বিমানের ১৪৪ জন যাত্রীর মধ্যে ছিল ১৬ জন স্কুল ছাত্রছাত্রী যারা স্টাডি-ট্যুর থেকে
ঘরে ফিরছিল।
জার্মানউইংস এয়ারলাইনারের এই ২৮ বছর বয়সী জার্মান
কো-পাইলট, আনদ্রিয়াস লুবিত্জ, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এই কোম্পানিতে চাকরী করছিলো।
সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করতো মন্টিবাওয়ার পশ্চিমাঞ্চলে। মন্টিবাওয়ার ডুসেলডর্ফেও
তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ২০০৯ সালে লুবিত্জ এর প্রশিক্ষণ কিছু সময়ের জন্য বিঘ্নিত হয়েছিল
মানুষিক বিষণ্ণতার কারনে। আনদ্রিয়াস লুবিত্জ ফ্লাইট ট্রেনিং নেবার আগে কেবিন আটেন্ডেন্ট
হিসেবে এক বছর চাকরী করেছে। জার্মানউইংস এর তদন্তকারী দল জানতে পেরেছে যে তাকে অন্য
পাইলটরা ‘টমাটো অ্যান্ডি’ বলে খেপাতো কারণ সে আগে কেবিন আটেন্ডেন্ট
ছিল। লুবিত্জ কয়েকবার অথরিটিকে জানিয়েছে যে সে লং রুটে ফ্লাই করতে চায়। প্রতিবারই তাকে
না বলা হয়েছে তার পূর্ব মানসিক অবস্থার কারনে। তার ঘর তল্লাসি করার পরে তার অসুস্থতার
বিষয়ে নতুন আরও ক্লু পাওয়া যায়। জানা যায় যে তার ডাক্তার তাকে কিছুদিন বিমান চালাতে
নিষেধ করেছিলো। হতে পারে সে চাকরী হারানোর ভয়ে বিমর্ষ ছিল আর সেই মানসিক অবস্থা থেকে বেড়িয়ে না আসতে পেরেই
বিমানটি বিধ্বস্ত করার সিধান্ত নেয়। মানসিক
বিপর্যস্ত মানুষের কাছে অন্য ১৪৯ টা প্রান কিছুই না।
এই ঘটনাটা অস্বাভাবিক নয় কারণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত
পাইলটেরা এটা করতেই পারেন। আবার এরকম ঘটনা তেমন বিরলও নয়। ইতিহাসে এমন বেশকিছু ঘটনার
নজির রয়েছে যেখানে পাইলট অথবা কো-পাইলটরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিমান বিধ্বস্ত করেছেন। কিছু
এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
ইজিপ্টএয়ার : ৩১ অক্টোবর ১৯৯৯
ইজিপ্টএয়ার ফ্লাইট ৯৯০ নামের একটি বোয়িং-৭৬৭ বিমান
নিউইয়র্ক থেকে মিশরের কায়রোর উদ্দেশে যাত্রা করে। উড্ডয়নের অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানটি
আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা ২১৭ জন যাত্রীর সবাই মারা যায়। পরবর্তীতে
ব্লাক বক্সে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বিমানের পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটিকে
আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত করেন। এমনকি বিধ্বস্ত করার আগে তিনি একটি ঘোষণাও দেন।
সেটা ছিল ঠিক এরকম, “আমি
আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আমার বিশ্বাস স্রষ্টার উপর সোপর্দ করলাম।" এই
পাইলট কে ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগে জানানো হয়েছিলো যে তার বিরুদ্ধে এয়ার হোস্টেসদের করা
নালিশ প্রমানিত হয়েছে এবং দেশে ফিরে তাকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।
মোজাম্বিক এয়ারলাইন্স - ২৯ নভেম্বর ২০১৩
মোজাম্বিক এয়ারলাইন্স ফ্লাইট টিএম ৪৭০ মাপুতো থেকে
লুয়ান্ডায় যাচ্ছিল। বিমানটি হঠাৎ করে নামিবিয়ার উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয় এবং
৩৩জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ফ্লাইটের রেকর্ড থেকে জানা যায় যে ক্যাপ্টেন হার্মিনিও ডস
সান্তোস ফার্নান্দেস স্বপ্রণোদিত হয়েই বিমানটি বিধ্বস্ত করেন। অন্যান্য পাইলটরা ককপিটের
বাইরে আটকা পড়েছিলেন এবং বার বার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তারা দরজায় সজোরে আঘাতও
করেছিলেন, লাভ হয়নি।
সিল্ক এয়ার - ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৭
সিঙ্গাপুরের সিল্ক এয়ার এর বোয়িং ৭৩৭ সিঙ্গাপুর থেকে
ইন্দোনোশিয়ার জাকার্তা যাচ্ছিল। কিন্তু যাত্রাপথে বিমানটি ইন্দোনেশিয়ার একটি নদীতে
আছড়ে পড়ে। বিমানে থাকা ১০৪জন যাত্রী ও বিমানের ক্রুরা সবাই মারা যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
তদন্ত দল জানতে পারে যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটি বিধ্বস্ত করেছেন।
এর কিছুদিন আগে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য এই পাইলটের পদাবনতি হয়। পাশাপাশি তিনি ঋণগ্রস্তও
ছিলেন।
রয়েল এয়ার মারক :-২১ আগস্ট ১৯৯৪
রয়েল এয়ার মারক জেট বিমানটি আগাদির থেকে কাসাব্লাঙ্কা
যাচ্ছিল কিন্তু উড্ডয়নের অল্প কিছুক্ষণ পরেই অ্যাটলাস পর্বতে বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা
৪৪ জন যাত্রীর সবাই মারা যায়। বিমানের কো-পাইলটের শেষ শব্দটি তদন্তকারী দল বিশ্লেষণ
নিশ্চিত হন যে পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটি বিধ্বস্ত করেছেন। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে কো-পাইলটের
বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
জাপান এয়ারলাইন্স - ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২
জাপান এয়ারলাইন্সের ডিসি-৮ নামের একটি বিমান হানেদা
বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যাওয়ার পথে টোকিওর উপসাগরে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি।
বিমানে ২৪জন যাত্রী ছিলেন; তারা সবাই মারা যায়। তদন্ত করে দেখা যায় এই পাইলট মানসিকভাবে
অস্থির ছিলেন।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স - ৮ মার্চ ২০১৪
অনুমান করা হয় যে ২০১৪ সালের ৮ মার্চ ২৩৯ জন যাত্রী
নিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি নিঁখোজ হয়েছে সেটার পেছনেও পাইলটের আত্মহত্যার
বিষয়টি জড়িত আছে। কারণ, পাইলট ইচ্ছা করেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন
এবং বিমানের রুট পরিবর্তন করেছিলেন।
পাইলট ও ক্রুদের যে এয়ারলাইন্স নিয়োগ দিয়ে থাকে তারা
সব সময় পাইলট ও ক্রুদের বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে নেয়। বিমানবন্দরেও নিয়মিত পাইলট ও ক্রুদের
নানা পরীক্ষা করা হয়। পাশাপাশি বিমানে কাজ করার সময় সব পাইলটকেই ডাক্তারি পরীক্ষার
মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসব পাশ কাটিয়ে বিমানের নিখোঁজ হওয়া ও বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে
যাচ্ছে। গেল এক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা যদিও বিমান ভ্রমন
এখন অতীতের যে কোন সময়ের চাইতে সবচেয়ে নিরাপদ।
এয়ারলাইন্সগুলো নিশ্চিত ভাবে তাদের পাইলটদের এখন নতুন করে মূল্যায়ন করবে। বেশকিছু
এয়ারলাইন্স ইতিমধ্যে সিধান্ত নিয়ে নিয়েছে নতুন নিয়ম করার যেখানে ফ্লাইট চলাকালীন সময়ে
এক জনের বেশী পাইলটের ককপিটে থাকতে হবে। তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিশ্চত করা যে
পাইলট অথবা কো-পাইলট মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বা বিষাদগ্রস্থ নয়। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
করা কঠিন হবে কারণ বিশ্বে বিষাদগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
Comments