পরাক্রমশালী সম্রাট আকবরের বশ্যতা অস্বীকার করে বীরদপে সোনারগাঁও থেকে জঙ্গলবাড়ী, সরাইল থেকে রংপুর এলাকায় বিরাজ করা বীরের নাম ঈসা খাঁ। তিনি মোগলদের আক্রমণকে বারবার প্রতিহত করেছেন এবং আকবরের কাছ থেকে সম্মান অর্জন করে নিয়েছেন নিজ স্বকীয়তায়।
আকবরের শাসনামলে ভারতের প্রায় সকল এলাকা মোগল কর্তৃত্বে এলেও বাংলাকে পুরোপুরি কব্জা করা যায়নি তেজস্বী ঈসা খাঁর সাহসীকতায়।
ঈসা খাঁর পিতা ছিলেন কালিদাস গজদানী। তিনি ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ব্যবসা বানিজ্য করতে আসেন।
এক সময় তিনি মুসলমান হন এবং নাম পরিবর্তন করে সোলায়মান খাঁ রাখেন।
মূলত ব্যবসা করে সোলায়মান খাঁ প্রচুর টাকা পয়সা, বিত্ত বৈভব অর্জন করেন।
পরে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের মেয়েকে বিয়ে করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জায়গীরদারী লাভ করেন।
ঈসা খাঁ ছিলেন সোলায়মান খাঁর প্রথম পুত্র। ঈসা খাঁ বাবার জমিদারী পেয়ে তীক্ষ-বিচার বুদ্ধির মাধ্যমে বাংলার অন্যান্য শাসকদের নিজ আয়ত্বে নিয়ে আসেন এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইলে নিজ শাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন।
সেসময় বাংলায় কয়েকজন স্বাধীন সামন্ত শাসক সম্মিলিত ভাবে মৈত্রিজোট গঠন করে নিজ নিজ এলাকা শাসন করতেন।
ঈসা খাঁর অধীনে ছিল সোনারগাঁও থেকে জঙ্গলবাড়ী, সরাইল থেকে রংপুর। সম্রাট আকবর বারবার সৈন্য পাঠিয়েছেন ঈসা খাঁকে পরাস্ত করতে। বর্তমান কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে, গাজীপুরের কালীগঞ্জে আর নারায়ণগঞ্জ জেলার খিজিরপুরে মোঘল সৈন্যদের সাথে ঈসা খাঁর যুদ্ধ হয়। বেশীরভাগ যুদ্ধে ঈসা খাঁ জয়ী হন।
১৫৯৫ সালে মোঘল সেনাপতি মানসিংহ আসেন ঈসা খাঁকে মোকাবেলা করতে। ব্রক্ষপুত্র তীরে এগারসিন্দুর দুর্গের পাশে, বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার সর্ব দক্ষিণ প্রান্তে, টাঙ্গার গ্রামে হয় শেষ যুদ্ধ। ঈসা খাঁ প্রস্তাব করেন দন্ধ যুদ্ধের।
মানসিংহ তাতে সম্মত হন। ঠিক হয় যিনি যুদ্ধে জয়ী হবেন তিনি সারা বাংলার কর্তৃত্ব লাভ করবেন।
চতুর মানসিংহ কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি পাঠান তার জামাতাকে।
তেজস্বী ও প্রতাপশালী ঈসা খাঁ মানসিংহের জামাতাকে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করেন।
ঈসা খাঁ মানসিংহকে কাপুরুষতার জন্য ধিক্কার দেন। অপমানিত হয়ে মানসিংহ খবর পাঠান তিনি পরদিন দন্ধ যুদ্ধে অংশ নেবেন।
ঈসা খাঁ সানন্দে রাজি হন।
তুমুল লড়াই হয় পরদিন। এক পর্যায়ে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে যায়। ঈসা খাঁ তাকে আঘাত না করে অন্য তলোয়ার নিতে বলেন। মানসিংহ ঘোড়া থেকে নেমে আসেন তবে অন্য তলোয়ার নিতে অস্বীকৃতি জানান।
ঈসা খাঁ তখন মানসিংহকে মল্লযুদ্ধে আহবান করেন।
কিন্তু মানসিংহ তা গ্রহণ না করে ঈসা খাঁকে আলিঙ্গন করেন।
মানসিংহ শান্তি-সন্ধি করেন এবং দিল্লীর দরবারে ফিরে গিয়ে বিষয়টি অবগত করে সম্রাট আকবরকে অনুরোধ করেন ঈসা খাঁকে ২২টি পরগনা শাসন করার অনুমতি প্রদান করতে। সম্রাট আকবর রাজি হন এবং ঈসা খাঁকে ‘মসনদ-ই আলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
ঈসা খাঁ বাংলায় সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন। বাংলায় প্রথম গেরিলা যুদ্ধের প্রচলনও ঈসা খাঁর সময় শুরু হয়। ঈসা খাঁ নিজেও গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন।
তার শাসনকালে বস্ত্র শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়।
১৫৯৯ সালের ২১ আগস্ট বক্তারপুরে মৃত্যুবরণ করেন ঈসা খাঁ।
-ওয়াসীম সোবহান চৌধুরী
জানুয়ারী ২০১৫
Comments